আপনি যেভাবে আপনার আবেগকে নিয়ন্ত্রন করবেন

"অতি আবেগে বিবেক নষ্ট" এই কথাটার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। আপনি যদি অতি আবেগী হয়ে থাকেন, আপনার যদি নিজের অনুভূতিগুলোর উপর নিজের নিয়ন্ত্রন না থাকে, তাহলে আপনি বাস্তব জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে উঠতে বসতে সমস্যায় পড়বেন। সৌভাগ্যবশত নিচে বর্ণিত পাঁচটি বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে আপনিও পারবেন আপনার আবেগকে বশ মানাতে। 


চলুন এবার জেনে আসি এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলো কি কি।

পেজ সুচিপত্রঃ  আপনি কিভাবে আপনার আবেগকে নিয়ন্ত্রন করবেন

নিজের শরীরের যত্ন নিন 

আপনার আবেগকে নিয়ন্ত্রনে রাখার প্রথম শর্তই হচ্ছে আপনার দৌহিক সুস্থতা এবং আপনি সুস্থ থাকতে চাইলে আপনাকে আপনার শরীরের যত্ন নিতে হবে। আপনার পর্যাপ্ত পরিমান ঘুম না হলে অথবা আপনি যদি মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন তাহলে আপনার দেহের প্রাকৃতিক ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যাবে। এর ফলে আপনার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে।

ভয় ও দুশ্চিন্তার মতো নেতিবাচক অনুভূতির কারনে  আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। আবার ঠিকমত ঘুম না হলে একজন ব্যাক্তি উদ্বেক জনিত মানসিক রোগ, বিষন্নতা ও  মেজাজ জনিত রোগে ভুগতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে সে উচ্চচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও বিভিন্ন প্রকার শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হবে।

যখন কেউ উপরে উল্লেখিত মানসিক ও শারীরিক রোগে ভুগতে থাকে তখন স্বাভাবিকভাবেই তার পক্ষে নিজের আবেগ কে নিয়ন্ত্রন করা কঠিন হয়ে পড়ে। সে সামান্য ভুল ত্রুটির কারনে অন্যের উপর রাগ ঝাড়ে, অল্প দুঃখেই মুষড়ে পড়ে এবং সে সমাজে ফাংশান করতে পারে না। একইসাথে পরিবারের অন্য সদস্যদের তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং সে পরিবারের বোঝায় পরিনত হয়।

নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করা, সুষম খাদ্য গ্রহন করা, সময় মতো ঘুমাতে যাওয়া এবং ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখার মাধ্যমে আমরা আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে পারি। যেসব ছোট ছোট কাজ আপনি উপভোগ করেন তা যদি আপনি আপনার দৈনন্দিন জীবনে অর্ন্তভুক্ত করতে পারেন তবে আপনি মানসিকভাবেও অনেক এগিয়ে থাকবেন। মনে রাখবেন, আবেগকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারাই সুস্থ মনের পরিচয় দেয়।


আপনজনদের সাথে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক বজায় রাখুন

পরিবার বা বন্ধুদের মাঝে এমন একজন থাকা যাদের সাথে আমরা নির্দ্বিধায় আমাদের চিন্তা ভাবনা শেয়ার করতে পারি; আমাদের অনুভুতিগুলোকে নিয়ন্ত্রন করার আর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। এটা আমাদের মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে এবং আমাদেরকে সংযতভাবে মনোভাব প্রকাশ করতে দেয়। সুতরাং আমাদের পরিচিত মানুষদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা উচিৎ। 

গবেষকদের মতে, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে আমাদের যেসব পুরনো বন্ধু বান্ধব রয়েছে যাদের সাথে আমাদের খুব একটা যোগাযোগ নেই, তাদেরকে কল করে, ম্যাসেজ দিয়ে, তাদের জন্মদিন বা বিবাহ বার্ষিকীতে তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে পুনরায় তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিৎ। ইতিবাচক সামাজিক যোগাযোগ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। 

একজন মানসিকভাবে সবল ব্যাক্তির পক্ষেই সম্ভব তার আবেগর উপর পুর্ন নিয়ন্ত্রন অর্জন করা।   


আপনার অনুভুতিগুলোকে সঠিক উপায়ে প্রকাশ করুন 

আবেগ নিয়ন্ত্রনের দুইটি কার্যকারী পদ্ধতি হল অবদমন (Suppression) ও পুনর্মূল্যায়ন (Reappraisal). অবদমন হচ্ছে যখন আমরা আমাদের অনুভুতিগুলোকে চেপে রাখি, তাদেরকে প্রকাশ হতে দেই না। গবেষনায় দেখা গেছে, নেতিবাচক অনুভুতিগুলো চেপে রাখলে এক পর্যায়ে সেগুলো আরো শক্তিশালী ও বিকৃত রূপ নিয়ে ফিরে আসে। 

বর্তমানের মনোবিজ্ঞানীরা তাই আবেগকে চেপে রাখার পরিবর্তে সঠিক উপায়ে প্রকাশ করার উপর জোর দিয়ে থাকে। এজন্যে তারা আবেগের পুনর্মূল্যায়নকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আবেগের পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে ঠান্ডামাথায় ভেবে দেখা কিভাবে আমরা রাগ, দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভ এসব নেতিবাচক অনুভুতিগুলিকে নিয়ে অন্যভাবে চিন্তা করতে পারি কি না।

উদাহরন স্বরূপ, আপনি যদি একটা ভুল কাজ করে হতাশা বোধ করছেন। এখন যদি আপনি এই ভুল কাজটিকে একটি শিক্ষনীয় অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচনা করেন তাহলে আপনার হতাশা অনেক কমে যাবে। আপনি বরং এটিকে ইতিবাচক হিসেবে ভাবতে শুরু করবেন। 

এই লাইনের চিন্তাধারা আপনাকে জীবনকে অন্যভাবে দেখতে সাহায্য করবে। গবেষনায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষই জীবনের এক পর্যায়ে এসে তাদের আবেগ অনুভূতিগুলো পুনর্মূল্যায়ন করতে সক্ষম
হয়। 


মেডিটেশন বা ধ্যান করুন 


নিজের আবেগকে বশে আনার আর একটি সহজ উপায় হচ্ছে মেডিটেশন বা ধ্যানে বসা। এখন মেডিটেশন শব্দটা শুনলেই অনেকে ভয় পেয়ে যাবেন। আসলে এটা তেমন কঠিন কিছুই নয়। 

আপনি যদি প্রত্যেক দিন পাঁচ থেকে দশ মিনিট চোখ বন্ধ করে আপনার মন নিয়ে চিন্তা করেন তবে আপনি সহজেই আপনার আবেগের খুঁটিনাটি বুঝতে পারবেন। যখন আপনি ধ্যানে বসবেন তখন আপনের মনে কোন ধরনের অনুভূতি জাগ্রত হয় এবং আপনি কিভাবে তাতে সাড়া দেন তার প্রতি আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে। আপনি ঐ সময়ে নিজেকে আরও যেসব প্রশ্ন করতে পারেনঃ

  • আপনার মনে কি ধরনের অনুভূতি আসে, এবং কত ঘন ঘন তা আসে?
  • আপনার মনে যখন কোন বিশেষ অনুভূতি আসে তখন আপনার দেহ কি অনুভব করে?
  • আপনার মন কি অনুভব করে?
  • যখন আপনি অতি আবেগে অন্ধ হয়ে যান তখন কি আপনি কোন অপরাধ বোধ করেন?
  • আপনি কি আরও ভালো উপায়ে আপনার আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেন? 

আবেগীয় বিস্ফোরণ প্রতিহত করুন 

মনে করেন আপনি পারিবারিক, অর্থনৌতিক অথবা সামাজিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। তার উপর আপনি অফিসে কাজ করে কুলাতে পারছেন না। আপনি আপনার অনুভূতি চেপে রাখেন এবং সহজে তা প্রকাশ করতে পারেন না। এমন অবস্থায় আপনার সাথে এমন কিছু হল বা কেউ আপনাকে কিছু বলল, তখন আপনি আপনার রাগ, হতাশা, ক্ষোভ ধরে রাখতে পারলেন না। চিৎকার, চেঁচামেচি করে হুলস্থূল কান্ড ঘটিয়ে বসলেন। 

একেই বলে আবেগীয় বিস্ফোরণ (Emotional Outburst) l  এ রকম অপ্রিতিকর ঘটনা প্রমান করে আমরা আমাদের আবেগকে যথাযথ ভাবে নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আবেগীয় বিস্ফোরণ শুধু মনের অবস্থাই প্রকাশ করে না, এটি নানা রকম শারীরিক অসুস্থতাও নির্দেশ করতে পারে।

এটাকে প্রতিহত করার কিছু পরীক্ষিত উপায় রয়েছে। উদাহরন স্বরূপ, আপনি যে কারনে দুশ্চিন্তা অনুভব করছেন, যে বিষয়গুলো আপনাকে চাপের মধ্যে ফেলছে তা চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী ব্যাবস্থা নেওয়া। সময় মতো ঘুমানোর অভ্যাস করা, শরীরের যত্ন নেওয়া, যতটুকু সম্ভব চাপ কমিয়ে আনা ও ব্যাক্তিগত জীবনে কিছু সীমানা নির্ধারন করে আপনি এসব করতে পারেন।

নেতিবাচক অনুভূতি যাতে আপনার মনে বাসা বাঁধতে না পারে সেজন্যে আপনাকে দৃঢ় ভাবে আপনার মতামত, আপনি কিসে অস্বস্তি বোধ করছেন, আপনার কি ভালো লাগছে না বলতে হবে। আপনি যদি আপনার আশেপাশের লোকদের আপনার লিমিট জানান তবে তারাও ভবিষ্যতে আপনার সাথে সংযত ব্যবহার করবে।  

আপনি যদি বুঝতে পারেন আপনার আবেগীয় বিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে তবে আপনার সে জায়গা থেকে দ্রুত সরে আসা উচিৎ। আপনি বাহিরে থেকে এক্টূ ঘুরে আসুন, কোথায় বসুন অথবা বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে আসুন। প্রয়োজন হলে গুন গুন করে আপনার পছন্দের গানটি গাইতে পারেন। 


শেষ কথা 

আমাদের আবেগের উপর আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করা একটা লম্বা যাত্রা। এই যাত্রায় সফল হতে হলে ব্যাপক ধৈর্য এবং অনুশীলনের প্রয়োজন আছে। আমাদের অনুভুতিগুলোকে চাপিয়ে না রেখে, সেগুলো সুস্থ্য ভাবে প্রকাশ করার মাধ্যমে আমরা জীবনের বিভিন্ন প্রতিকুল পরিবেশকে শান্তভাবে মোকাবেলা করতে শিখব।  

সবশেষে বলা যায়, নিয়ন্ত্রিত আবেগ কেবল আমাদের মানসিক সুস্থতাকেই বাড়ায় না, বরং অন্যদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককেও উন্নত করে। সময় ও প্রচেষ্টার সাথে আমরা আমাদের অনুভুতিগুলোকে শক্তির উৎসে পরিনত করতে পারি। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url