বিভিন্ন সমাজ এবং সংস্কৃতিতে যেসব অতিপ্রাকৃতিক সত্তাতে বিশ্বাস করা হয়

 

ইতিহাস জুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে অতিপ্রাকৃত সত্তাদের নিয়ে এমন সব কাহিনী রচিত হয়েছে যেখানে তাদের বিশ্বাস, ভয় এবং মুল্যবোধের প্রতিফলন ঘটেছে। রক্ষাকারী আত্মা থেকে শুরু করে ভয়ঙ্কর প্রানি পর্যন্ত, এই সত্তাগুলোকে নিয়েই বৈচিত্রময় লোককথা গড়ে ওঠে এবং তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমাদেরকে বিস্মিত ও বিনোদিত করে।

প্রত্যেক সংস্কৃতির অতিপ্রাকৃত সত্তাগুলো অনন্য বৈশিষ্ট্য ধারন করে এবং তারা তাদের গল্পগুলোতে তাদের প্রকৃতি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করে। এই আর্টিকেলটিতে বিশ্বর বিভিন্ন প্রান্তের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক কিছু অতিপ্রাকৃত সত্তার কথা তুলে ধরা হয়েছে, যা জীবন এবং অজানা বিষয়গুলো সর্ম্পকে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাভাবনাগুলোকে তুলে ধরে।    

সূচিপত্র 

স্কিন ওয়াকার (Skin Walker)

বিভিন্ন-সমাজ-এবং-সংস্কৃতিতে-যেসব-অতিপ্রাকৃতিক-সত্তাতে-বিশ্বাস-করা-হয়

উত্তর আমেরিকার নাভাহো আদিবাসীরা বিশ্বাস করে যে তাদের গোত্রের কোন সদস্য ভয়ঙ্কর এবং নিষিদ্ধ জাদুবিদ্যার সাহায্যে যে কোন পশুপাখি এবং মানুষের রূপ নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করলে সে একটা স্কিন ওয়াকারে পরিণত হয়। কিংবদন্তি অনুসারে, একটি স্কিন ওয়াকার গুরুতর নিষিদ্ধ কাজ, যেমন নিজের পরিবারের কোন সদস্যকে হত্যা এবং তাদের মাংস ভক্ষন করার মাধ্যমে অতিপ্রাকৃত শক্তি লাভ করে। তাদের যে কোন রূপ নেওয়ার ক্ষমতা  এবং মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকার জন্য স্কিন ওয়াকার কে  উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের লোককথার এক অন্যতম ভীতিকর চরিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

লোককথা অনুসারে, স্কিন ওয়াকাররা তাদের ক্ষমতা সবসময় খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যাবহার করে; তাদের উপস্থিতি আশেপাশের লোকেদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। একটা স্কিন ওয়াকার যাকে টার্গেট করে সে তার প্রিয়জনদের কন্ঠ নকল করে টার্গেটকে ধোঁকা দেয় এবং তাদেরকে বিপদজ্জনক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায়। কিছু গল্পে বলা হয়, স্কিন ওয়াকাররা শুধুমাত্র তাদের শিকারের চোখে চোখ রেখে শিকারকে পঙ্গু করে দেয় এবং তাদের শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এই অবস্থায় ভিক্টিম অসহায়ভাবে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। 

নিজের ইচ্ছেমত যে কোন প্রাণীর রূপ ধারন করা স্কিন ওয়াকারদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। একটা স্কিন ওয়াকার তার উদ্দেশ্য এবং সে কি ধরনের ক্ষতি করতে চায় সেই অনুযায়ী তার রূপ পরিবর্তন করে। উদাহরন স্বরুপ, শিয়ালের রপ ধারন করা একটি স্কিন ওয়াকার তার শিকারকে ধোঁকা দিতে পারে, অন্যদিকে নেকড়ে রূপি স্কিন ওয়াকার শিকারকে অনুসরন করা এবং শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আবার পাখির রপ ধারন করে তারা সহজেই বিপদ থেকে পালাতে পারে।   

একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, নাভাহোরা প্রকাশ্যে স্কিন ওয়াকার নিয়ে কথা বলতে ভয় পায়। তারা মনে করে স্কিন ওয়াকার নিয়ে কথা বললে তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়। শুধু তাই নয়, তাদেরকে নিয়ে বেশি চিন্তা করলে স্কিন ওয়াকারদের শক্তি বেড়ে যায়। অনেক নৃতাত্ত্বিকদের মতে, নাভাহোরা স্কিন ওয়াকার সম্পর্কে অনেকে কিছু জানলেও তা তারা তাদের গোত্রের বাহিরের লোকেদের কাছে প্রকাশ করে না। 

পেনাংগালান (Penanggalan)

বিভিন্ন-সমাজ-এবং-সংস্কৃতিতে-যেসব-অতিপ্রাকৃতিক-সত্তাতে-বিশ্বাস-করা-হয়


পেনাংগালান দক্ষিন-পুর্ব এশিয়া বিশেষ করে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার লোককথার এক ভয়ংকর চরিত্র। এটিকে এক ধরনের রক্তচোষা আত্মা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পেনাংগালানকে একজন সুন্দরী মহিলা হিসেবে কল্পনা করা হয় যার মাথা রাতের বেলায় শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং মাথার নিচে অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো ঝুলে থাকে। রাতের বেলায় এই প্রাণীটি রক্তের খোঁজে, বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও নবজাতকদের রক্তের খোঁজে উড়ে বেড়ায়।

দিনের বেলায় পেনাংগালান কোনরকম সন্দেহ সৃষ্টি করা ছাড়াই একজন সাধারন নারী হিসেবে সমাজে বসবাস করে। কিন্তু রাত নামলেই সে তার মাথা, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এবং নাড়ি ভুঁড়ি সহ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে শিকারে বেড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এ সময় তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে হাল্কা আলোর আভা বের হয় যা তাকে অন্ধকারে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। সে চাইলেই কোন বাড়ির ছোট ছোট ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সহজেই প্রবেশ করতে পারে। 

দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার সমাজগুলোতে পেনাংগালানকে প্রতিহত করার জন্য নানারকম পন্থা অবলম্বন করা হয়ে থাকে। পেনাংগালানকে অবশ্যই ভোর হবার আগেই তার বাড়ীতে ফিরে তার দেহের সাথে জোড় লাগাতে হবে; সে যদি তা না করতে পারে তবে সুর্যের আলোয় সে ধবংশ হয়ে যাবে। এইজন্যে, লোককথা অনুসারে, তার বাড়ির চারপাশে কাঁটাযুক্ত লতাপাতা অথবা ভাঙা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে দিতে হবে অথবা রাতের বেলায় তার দেহের মাথাবিহীন অংশের উপর এসব জিনিস রাখতে হবে। এই ধারালো জিনিসগুলোতে তার মাথার সাথে ঝুলতে থাকা নাড়িভুঁড়ি আটকে যায়, এর ফলে পেনাংগালান তার মাথা ও দেহ একসাথে জোড়া লাগাতে পারে না। 

এছাড়াও, পেনাংগালান থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে স্থানীয় লোকজন তাদের বাড়ির দরজা ও জানালার চারপাশে কাটাযুক্ত লতাপাতা ঝুলিয়ে রাখে। অনেক সময় তার তাদের বাড়ীর আশেপাশে লবণ এবং ভিনেগার ছিটিয়ে দেয়, তারা বিশ্বাস করে এই বস্তুগুলো পেনাংগালান এর নাড়িভুঁড়ির ক্ষতি করবে যার ফলে সে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করবে না। 

পেনাংগালান এর গল্প মেয়েদের নিয়ে সমাজের বিভিন্ন ভয় ও দুশ্চিন্তার প্রতীক। বিভিন্ন লোককথা অনুসারে, পেনাংগালান এক সময় একজন সাথারন মহিলা ছিল যে রাগে/হিংসা অথবা বিপদে পড়ে কালো জাদুর চর্চা শুরু করে। এভাবে অশুভ শক্তির প্রভাবে একজন সাধারন মহিলার রাক্ষসে পরিণত হওয়া জ্ঞান ও ক্ষমতার অপব্যাবহার নিয়ে সমাজের উৎকন্ঠার প্রতিফলন ঘটায়। দক্ষিন এশিয়ার গ্রামীণ সমাজগুলোতে যেখানে মহিলা কবিরাজ এবং ধাত্রিদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে সেখানে পেনাংগালান এর কাহিনী তার সদস্যদের মনে করিয়ে দেয় যে কারও জ্ঞান এবং দক্ষতা স্বার্থপর ও ক্ষতিকর কাজে ব্যাবহার করা উচিৎ নয়। 


ফেয়ার ফোক (Fair Folk)

বিভিন্ন-সমাজ-এবং-সংস্কৃতিতে-যেসব-অতিপ্রাকৃতিক-সত্তাতে-বিশ্বাস-করা-হয়


ইউরোপীয় লোককথায় বিশেষ করে আইরিশ, স্কটিশ, ওয়েলস্‌ এবং ইংলিশ লোককথায় ফেয়ার ফোক, ফে (fae), ফেইরিস (fairies) নামের রহস্যময় অতিপ্রাকৃত সত্তার উল্লেখ রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে, এই সত্তাগুলো মানবজাতির সমান্তরালে একটি "অন্য জগৎ" (Otherworld) এ বসবাস করে বলে বিশ্বাস করা হয়। তারা মানবজাতি থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন এবং অপরিচিত এক ধরনের নীতি নৌতিকতা ও নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হয় ।

লোককথায় ফেয়ার ফোকদের বিচিত্র রূপ এবং আকারে চিত্রিত করা হলেও, তাদেরকে প্রায়ই  অপার্থিব রকমের সুন্দর অথবা ভয়ঙ্কর, রাক্ষস রূপে দেখা যেতে পারে। তারা ছোট্ট, পাখাওয়ালা জীব, মানব- আকৃতির সত্তা, অথবা মানুষের রূপ নিয়ে নিতে পারে। লোককথায় তারা যে রূপ ধারন করে তা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একধরণের সর্তকবার্তা দেয়। অতিসুন্দর রূপ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে বিপথে নিয়ে যায়, আবার অতি ভয়ঙ্কর রূপ ধারন করে তারা মানুষকে তাড়িয়ে দেয়। 

ফেয়ার ফোক তাদের নিজস্ব নিয়মে চলে যা মানুষের বোঝার ক্ষমতা নেই। তারা গোপনীয়তা পছন্দ করে এবং কোন ব্যক্তি যদি তাদের আসল পরিচয় প্রকাশ করে দেয় বা তাদের কোন নিয়ম ভংগ করে তবে তারা সাথে সাথেই সেই ব্যাক্তিকে শাস্তি প্রদান করে। কোন কোনও লোককথা অনুসারে, কোন ব্যাক্তি যদি ভুল করেও তাদের কোন সমাবেশ দেখে ফেলে তবে তারা ঐ ব্যাক্তিকে হয় অন্ধ করে দেয়, অথবা পাগল করে দেয় অথবা তাকে চিরতরের জন্যে অন্য জগতে নিয়ে যায়। গল্পগুলোতে তাই ফেয়ার ফোকদের সাথে যোগাযোগ করার সময় পাঠককে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, বিনয়ী হওয়া এবং সাবধান হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। 

ফেয়ার ফোকরা মানুষদের সাথে যোগাযোগ করার সময় তাদেরকে নানা রকম লোভনীয় প্রতিশ্রুতি এবং চুক্তিতে আবদ্ধ করার চেষ্টা করে। তারা নিজেদেরকে কঠোরভাবে চুক্তি মেনে চলে এমন ভান করলেও, তারা প্রায়ই মানুষকে প্রতারিত করতে চালাক ভাষার ব্যবহার করে। জ্ঞান, সম্পদ, বা প্রেমের বিনিময়ে ফেয়ার ফোকদের সাথে চুক্তির গল্পগুলোতে প্রধান চরিত্রের চুক্তির ফাঁদে আটকে যাওয়াকে শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে দেখানো হয়। 

লোককথা অনুসারে, ফেয়ার ফোকরা প্রকৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত, তাদেরকে প্রায়ই কোন নির্দিষ্ট অরন্য, নদী, এবং প্রাচীন ঢিবীর (যা তাদের "অন্য জগৎ" এ প্রবেশ করার পথ) রক্ষক হিসেবে ভাবা হয়। এই জায়গাগুলোর অভিভাবক হিসেবে তারা মানুষকে ঐসব জায়গার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট না করার জন্য সতর্ক করে। লোককথা অনুযায়ী, কেউ বনের মধ্যে ফেয়ার ফোকদের প্রিয় গাছ কাটলে অথবা তারা যেই জায়গাগুলোতে সচরাচর আসা যাওয়া করে সেসব জায়গার শান্তি বিনষ্ট করলে সে নিজের উপর দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে।

ফেয়ার ফোকদের লোককথা আমাদের প্রকৃতির রহস্য এবং মানুষের বোঝার বাইরেও যে আরেকটি জগৎ আছে সে ব্যাপারে আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়। তাদের গল্প প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য এবং বিপদের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এটি আমাদেরকে আরও মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃতির সবকিছু বোঝা এবং নিয়ন্ত্রন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। 


ওয়েন্‌ ডিগো (Wendigo)

বিভিন্ন-সমাজ-এবং-সংস্কৃতিতে-যেসব-অতিপ্রাকৃতিক-সত্তাতে-বিশ্বাস-করা-হয়


উত্তর আমেরিকার প্রধানত কানাডার অ্যালগংকুয়েন ( Algonquian) ভাষাভাষী ক্রিওজিবওয়ে, এবং ইনু গোত্রের আদিবাসীদের লোককথায় ওয়েন্‌ ডিগো নামের এক অতিপ্রাকৃতিক সত্তার সন্ধান পাওয়া যায়। এই আদিবাসীরা যেখানে বসবাস করে সেখানে শীতকালে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে এবং প্রাচীনকালে সেই সময়ে প্রায়ই খাবারের অভাব পড়ত। তাদের কাছে ওয়েন্‌ ডিগো লোভ, দুর্ভিক্ষ, একাকিত্ব এবং সর্বোপরি স্বার্থপরতার ভয়াবহ প্রতীক।  

লোককথা অনুসারে, ওয়েন্‌ ডিগো একটা অশারীরিক, অশুভ প্রেতাত্মা যেটা বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়।  ওই অঞ্চলে শীতে অনেকে দিন না খেয়ে আছে এমন কাউকে সে টার্গেট করে। তাকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে তাদের মাংস খেয়ে তাঁর ক্ষুধা মেটানোর জন্য ওয়েন ডিগো তাকে প্ররোচিত করে। প্ররোচিত ব্যাক্তি ওয়েন ডিগোর প্রভাবে নরখাদক হয়ে গেলে, ওয়েন ডিগো ঐ ব্যাক্তির উপর ভর করে এবং আস্তে আস্তে তাকে একটি রাক্ষসে পরিণত করে।

 শারীরিকভাবে ওয়েন্‌ ডিগো কে একটি কংকালসার, শীর্ণ দেহযুক্ত প্রানী হিসেবে কল্পনা করা হয়, যার  ত্বক হাড়ের উপর শক্তভাবে টান টান অবস্থায় থাকে। এর হাত এবং পা গুলো অনেক লম্বা হয়, এর ধারালো নখ থাকে এবং এর মুখ মৃতদের মত শুকিয়ে যাওয়া অবস্থায় থাকে। কিছু কিছু গল্প অনুসারে, এর মাথায় হরিনের মত শাখা প্রাশাখা বিছানো একজোড়া শিং থাকে। 

এভাবে যারা ওয়েন্‌ ডিগোতে পরিণত হয় তারা সবসময়ের জন্য মানুষের মাংস খাবার জন্য ক্ষুধার্ত থাকে; কিন্তু এরা যতই খেতে থাকে ততই এদের ক্ষুধা বাড়তে থাকে। সুতরাং ওয়েন্‌ ডিগো প্রতীকী ভাবে মানুষের অন্তহীন লোভ লালসা এবং স্বার্থপরভাবে শুধু বেঁচে থাকার জন্য সকল নীতি নৈতিকতা বর্জনের ফলে একজন মানুষের আত্মার যে পচন ঘটে তাকে নির্দেশ করে। 

অ্যালগংকুয়েন সংস্কৃতিতে ওয়েন্‌ ডিগোর কাহিনী কঠিন সময়ে বেঁচে থাকার জন্যে সমাজ এবং সামাজিক সহযোগিতার গুরুত্ব বোঝায়। কঠিন শীতের সময় যখন খাবার সীমিত হয়ে যেত তখন গোত্রের সদস্যদের বেঁচে থাকার জন্য একে অপরের উপরই নির্ভর করতে হত। এই মিথ তাদেরকে লোভ এবং স্বার্থপরতার ব্যাপারে সতর্ক করে; কারন লোভ ও স্বার্থপরতা তাদের আক্ষরিক এবং আথ্যাত্বিক ধ্বংশ ডেকে আনবে। এটি প্রতিকুলতার মুখে নৈতিক শক্তি ও সামাজিক  ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। 


বাবা ইয়াগা (Baba Yaga)

বিভিন্ন-সমাজ-এবং-সংস্কৃতিতে-যেসব-অতিপ্রাকৃতিক-সত্তাতে-বিশ্বাস-করা-হয়


বাবা ইয়াগা স্লাভিক লোককথা বিশেষ করে রাশিয়ান, ইউক্রেনিয়ান এবং পোলিশ লোককথার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং রহস্যময় চরিত্র গুলোর মধ্যে একজন। তাকে প্রায়ই একজন প্রাচিন, ডাইনি বুড়ি হিসেবে চিত্রিত করা হয়। সে বনের গভীরে একটা কুঁড়েঘরে বাস করে, কুঁড়েঘরটি আবার দুইটি মুরগীর পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তার চেহারা এবং আচরনও বেশ আজবঃ তিনি একটি বড় হামানদিস্তার হামানের (mortar) মধ্যে বসে উড়েন, দিস্তাকে (pestle) বাতাসে নৌকার বৈঠার মত ব্যবহার করেন এবং তার দাঁত গুলো লোহা দিয়ে বানানো। 

বাবা ইয়াগার বাসস্থান, মুরগির পায়ে দাঁড়ানো কুঁড়েঘর, তার অন্যতম স্মরনীয় বৈশিষ্ঠ্য যেটা তার প্রকৃতির নিয়ম থেকে স্বাধীন থাকার একটা প্রতীক হিসেবে কাজ করে।  ঘরটি ঘুরতে ও চলতে পারে যা তার সহজাত ক্ষমতা এবং নিজের পরিবেশের উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রদর্শন করে। তার কুঁড়েঘরটি প্রায়ই মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি একটা বেরা দিয়ে ঘেরা থাকে। কিছু কিছু গল্প অনুসারে তার কুঁড়েঘরে ঢুকতে হলে একটা নির্দিষ্ট মন্ত্র বলতে হয়। এই দিকটি তাকে মানুষের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাবলম্বী একটি সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করে। 

বাবা ইয়াগার চরিত্রের একটি অনন্য দিক হলো সাহায্যকারী এবং ভিলেন হিসেবে তার দুই রূপ ধারন করা। কোন কোন গল্পে তাকে ভয়ঙ্কর, নরখাদক ডাইনী রূপে দেখানো হয় যেখানে সে বনের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলা ভ্রমণকারী ও ছোট বাচ্চাদের শিকার করে। আবার অন্য গল্পে তিনি প্রধান চরিত্রের সাহসিকতা যাচাই করেন অথবা কেঊ সম্মানের সাথে যোগাযোগ করলে তাকে যাদুকরী সাহায্য প্রদান করেন। এই দ্বৈততা তাকে একটি জটিল চরিত্রে রুপান্তরিত করে যা দয়া ও নিষ্ঠূরতা, জ্ঞান ও ভয় উভয় দিকই ধারন করে। 

বাবা ইয়াগার  জীবন, মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম এই তিনটি বিষয়ের সাথে জড়িত। বন এবং পশুদের সাথে তার সংযোগ তাকে প্রকৃতির চক্রের সাথে যুক্ত করে যেখানে জীবন ও মৃত্যু চিরকাল ভারসাম্যের মধ্যে থাকে।এভাবে বাবা ইয়াগার গল্প প্রকৃতির রহস্যময় এবং প্রায়শই পরস্পরবিরোধী শক্তির এক চিরন্তন প্রতীক হয়ে থাকবে।  

শেষ কথা

বিভিন্ন সংস্কৃতিতে অতিপ্রাকৃত সত্তার বৈচিত্র মানবজাতির অজানার প্রতি কৌতুহল এবং আমাদের পৃথিবীকে গঠনকারী শক্তিগুলোর প্রতি আমাদের আগ্রহকে তুলে ধরে। এই সত্তাগুলো আকার এবং প্রকৃতিতে ভিন্ন হলেও তারা ভয়, সুরক্ষা, নৈতিকতা এবং জীবনের রহস্য জাতীয় সার্বজনীন থিমগুলোকে প্রতিফলিত করে। 

এই গল্প গুলোকে পড়া এবং গবেষনা করার মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের সংস্কৃতিকে গভীর ভাবে বুঝতে পারা সম্ভব হয়। সবশেষে বলা যায়, অতিপ্রাকৃত সত্তাগুলো আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে গল্প বলার ক্ষমতার মাধ্যমে আমরা মুল্যবোধ প্রকাশ করতে, অজানা বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে এবং ঐতিহ্যকে জীবিত রাখতে পারি।  
    



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url