মৃত্যু ও পরকাল নিয়ে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার বিশ্বাস।

 জন্মিলে মরিতে হইবে এটা একটা অমোঘ সত্য। মৃত্যুর পর আমাদের কি হবে, আমাদের আত্মা কোথায় যাবে, এনিয়ে কৌতূহলী নয় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। খুব সম্ভবত আমরা নিজেরা না মরা পর্যন্ত আমরা জীবনের এই রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারব না। 

মৃত্যুর পরে কি হবে তা নিয়ে প্রাচীনকালে বিভিন্ন সভ্যতার নিজস্ব বিশ্বাস ও প্রথা প্রচলিত ছিল। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে এবং ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উৎপন্ন হবার কারনে তাঁরা পরকাল সম্পর্কে তাদের নিজস্ব একটা বিশ্বাস ব্যাবস্থা গড়ে উঠেছিল। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেসব কথা। 

পোষ্টপৃষ্ঠাসূচিঃ 

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা 


প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় The Book of The Dead বা মৃতদের বই নামের একটা বই ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। এই বইটি থেকেই প্রাচীন মিশরীয়রা পরকাল নিয়ে কি ভাবত তা জানা যায়। বইটিতে একজন ব্যাক্তিকে পরকালে সাহায্য করার জন্য নানা রকম জাদুকরী তন্ত্র মন্ত্র ও সুত্র আছে। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত পরকাল হচ্ছে এই জীবন বা ইহকালের  একটা ধারাবাহিক অংশ। যখন কেউ মৃত্যবরন করে তখন প্রথমে তার আত্মা সত্যের প্রাসাদ (Hall of Truth) নামের একটা জায়গায় যায়। সেখানে তার নানা রকম পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং সে যদি উত্তীর্ণ হয় তাহলে তাকে আর একটি চুড়ান্ত পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।

প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে মানুষের হৃদপিণ্ডের মধ্যে তার ভালো ও মন্দ সকল কাজের হিসাব লিখা রয়েছে। সুতরাং, একজন মৃত ব্যাক্তির হৃদপিণ্ডকে একটি দাঁড়িপাল্লায় বসানো হয়। দাঁড়িপাল্লার অপর প্রান্তে বসানো হয় সত্য ও ন্যায়বিচার এর দেবী মাআ'আত (Ma'at) এর একটি পালক। যদি মৃত ব্যাক্তির হৃদপিণ্ডটি পালকের তুলনায় হালকা হয়  তাহলে ঐ মৃত ব্যাক্তি জীবিত অবস্থায় ভালো লোক ছিল না এবং এর শাস্তি হিসেবে তার আত্মাকে আমুত (Ammut) নামের একটা রাক্ষস খেয়ে ফেলে। 

অপরদিকে, ঐ মৃত ব্যাক্তির হৃদপিণ্ড ও পালক যদি দাঁড়িপাল্লায় সমান হয়ে থাকে তাহলে সে তার চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাস করেছে। তখন তার আত্মাকে স্বর্গে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। 

প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা 



প্রাচীন গ্রীকদের মতে যখন কেউ মারা যায়, তখন তার আত্মা মাটির অনেক নিচে পাতালে চলে যায়। এই পাতাল  পাঁচটি নদী দিয়ে ঘেরা।এগুলো হচ্ছেঃ আশেরন (Acheron, আর্তনাদের নদী), ককাইটাস (Cocytus, হাহাকার এর নদী), ফ্লেগা্থন (Phlegethon, আগুন এর নদী), স্টিক্স (Styx, ঘৃণার নদী) এবং লিথি (Lethe, বিস্মৃতির নদী)। একজন আত্মা এই পাতালে যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্যে হারমিস (Hermes) নামের এক দেবতা তাকে পথ দেখিয়ে স্টিক্স নদীর ধারে নিয়ে যায়। 

এই নদীর ধারে শ্যারন (Charon) নামের এক মাঝি তার নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করে। যদি মৃত ব্যাক্তির আত্মা শ্যরনকে নদী পার করিয়ে দেবার বিনিময়ে কিছু পয়সা দিতে পারে তবেই শ্যারন তাকে নদী পার করিয়ে দেয়। আবার মৃত ব্যাক্তির যদি শ্যারনকে দেবার কিছুই না থাকে তবে তাকে চিরতরের জন্যে ইহকাল ও পরকালের মাঝে আটকা পড়ে থাকতে হয়। এই কারনে প্রাচীন গ্রীস ও ইতালিতে কেউ মারা গেলে তার আত্মীয়রা তার ঠোঁটের উপর কিছু পয়সা রেখে কবর দিত। 

নদীর ওপর পাশে রয়েছে মৃতদের জগতে প্রবেশের দরজা। এই দরজা পাহারা দেয় সার্বিরাস (Cerberus) নামের তিন মাথাওয়ালা এক দৌত্যকার কুকুর। সে সব আত্মাকে মৃত্যুপুরীতে প্রবেশ করতে দেয় কিন্তু কাউকে বের হতে দেয় না। মৃতের জগতে প্রবেশের পর মৃত ব্যাক্তির আত্মাকে রাডামান্থুস (Rhadamanthus), মিনোস (Minos) ও এইয়াকুস (Aeacus) নামের তিনজন বিচারকের সামনে তার আমলনামা বলতে হয়। 

বিচার হয়ে যাবার পর একজন মৃত ব্যাক্তির আত্মার তিনটি পরিণতি হতে পারে। সে যদি তার জীবনে ভালো ও মন্দ কাজ প্রায় সমান সমান করে, তবে তাকে আস্ফোডেল (Asphodel) নামের এক অন্তহীন, ধুসর ও বিষণ্ণ প্রান্তরে পাঠিয়ে দেও্য়া হয়। সেখানে সে চিরকালের জন্যে লক্ষ্যহীণভাবে ঘুরে বেড়াবে। সাহসী, বীর এবং ভালো লোকদের আত্মা এলিসিয়াম (Elysium) নামের স্বর্গে প্রবেশ করে। আবার খারাপ লোকদের আত্মাকে টার্টারুস (Tartarus) নরকে নিক্ষেপ করা হয়।  

অ্যাজটেক সভ্যতা 



খ্রিষ্টীয় তের শতকে বর্তমান মেক্সিকোতে অ্যাজটেক সভ্যতার উত্থান ঘটে।পরকাল নিয়ে অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার চেয়ে তাদের ধারনা আলাদা ছিল। তাদের মতে মৃত্যুর পর আত্মার নিয়তি ঠিক হয় সে কিভাবে মারা গেছে তার উপর, সে জীবিত থাকা অবস্থায় কি করেছে তার উপর নয়। 

অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করত পরকাল উত্তর, দক্ষিন, পূর্ব ও পশ্চিমভাগে বিভক্ত। যেসব মহিলা বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে মারা গেছে তাদের আত্মা পূর্বদিকের পরকালে অবস্থান করে। সেখানে তাঁরা সূর্যোদয় ঘটাতে সাহায্য করে। আবার কেউ যদি কুষ্ঠ রোগে মারা যায়, কারও মাথার উপর বাজ পড়লে অথবা কেও পানিতে ডুবে মারা গেলে তাঁরা দক্ষিন দিকের পরকালে চলে যায়। সেখানে তাঁরা ইচ্ছেমত খেতে পারে ও পান করতে পারে।  

কোন ব্যাক্তি বার্ধক্যজনিত কারনে মৃত্যুবরন করলে সে উত্তর দিকের পরকালে প্রবেশ করে। এই পরকাল আবার নয়ভাগে বিভক্ত। মৃত ব্যাক্তির আত্মা চার বছরের মধ্যে আটটি চ্যালেঞ্জ পূরণ করে নবম্ স্তরে গেলে তবেই তার আত্মা শান্তিতে থাকতে পারে। 

অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করত সূর্য যাতে প্রতিদিন উঠতে পারে সে জন্যে তাদের দুই প্রধান দেবতা হুইটজিলোপোচটলি (Huitzilopochtili) ও তেজকাটলিপোকা (Tezcatlipoca) অন্ধকারের সাথে চলমান যুদ্ধে লিপ্ত আছে। কোন যোদ্ধা যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেলে তার আত্মা পশ্চিম দিকের পরকালে এই দুই দেবতার সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক হিসেবে কাজ  করে। এভাবে চার বছর কাজ করার পর সে পৃথিবীতে একটা হামিংবার্ড রূপে পুনর্জন্ম নেয়। 

ভাইকিংদের বিশ্বাস


ভাইকিংরা বাস্তবে অনেক হিংস্র ও আগ্রাসী হবার কারনে পরকাল নিয়ে তাদের চিন্তা ভাবনা তাদের স্বভাবকে প্রতিফলিত করে। একজন ভাইকিং যোদ্ধা যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়াই করে মারা গেলে সে পরকালে ভাল্‌হালা (Valhalla) নামের যোদ্ধাদের এক প্রাসাদে প্রবেশ করবে। এই বিশাল প্রাসাদের ছাদ ঢাল (Shield) দিয়ে বানানো এবং নেকড়ে ও ঈগল পাখির দল এর পাহারা দেয়। একজন যোদ্ধার আত্মা সেখানে পৌছালে তাঁকে স্বয়ং ভাইকিংদের প্রধান দেবতা ওডিন (Odin) তাঁকে এক গ্লাস মিড দিয়ে স্বাগত জানায়। (মিড (Mead) হচ্ছে মধু দিয়ে বানানো একধরনের মিষ্টি মদ।)

ভাল্‌হালায় একজন ভাইকিং যোদ্ধা যতখুশি খেতে ও পান করতে পারে। তারা একে ওপরের সাথে মারমারিও করে। ভাইকিং পৌরানিক কাহিনী অনুসারে ওডিন তার পরম শত্রু ফেনরির (Fenrir) এর সাথে শেষ লড়াইয়ের জন্য ভাইকিং যোদ্ধাদের আত্মা সংগ্রহ করছে। এটাও বলা হয়ে থাকে যে প্রধান দেবতা ওডিন চায় বলেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে বীর যোদ্ধারা মারা যায়। ওডিন যখন শেষ লড়াইয়ের ডাক দিবে তখন সকল যোদ্ধারা ভাল্‌হালার ৫৪০ টা দরজা দিয়ে বের হয়ে আসবে। া 

ভাইকিং সংস্কৃতিতে রোগে ভুগে এবং শেষ বয়সে বিছানায় মৃত্যুবরন করাকে লজ্জাজনক ভাবা হত। এ সকল লোকেদের ভাগ্যে থাকত সবচেয়ে বাজে পরকাল। তাদেরকে কুয়াশায় ঘেরা এক জগতে নির্বাসন দেওয়া হয়। সেখানে তাদেরকে ধীরে ধীরে পচে যাচ্ছে এমন এক দেবী হেল্‌ (Hel) এর সাথে একসাথে বসে অখাদ্য, কুখাদ্য খেতে হয়। 

আবার কেউ সমুদ্রে ডুবে মারা গেলে তাদের আত্মারা সমুদ্র দেবতা এগির (Aegir) এর প্রাসাদে আশ্রয় পায়।

আবার যেসব ভাইকিং যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেছে অথচ ভাল্‌হালায় যাওয়ার মত বীরত্ব দেখাতে পারেনি তাদের আত্মারা Folkvangr নামের এক অনন্ত প্রান্তরে স্থান পায়। সেখানে তাঁরা শিল্পকর্ম তৈরি করে, একে অপরকে তাদের ্জীবনের গল্প শোনায় এবং যেসব মেয়ে কুমারী অবস্থায় মারা গেছে তাদেরকে সঙ্গ দেয়। 












এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url