আমাদের বয়স যত বাড়তে থাকে, আমাদের মাথার চুলও তত পাতলা হয়ে আসে। যদিও এটা একটা
বয়স জনিত স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু তারপরেও অতিরিক্ত চুল পড়ার কারনে মাথায় টাক পড়ুক
এটা কেউই চায় না। ছেলেদের চুল পড়া বন্ধ করা এবং চুলের যত্ন নেয়ার জন্য পৃথিবীর
বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতিতে নানা রকম প্রাকৃতিক পন্থা অবলম্বন করা হয়ে থাকে।
চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক ছেলেদের চুল পড়া বন্ধে সেরকম ৯ টি প্রাকৃতিক
উপায়গুলো।
ছেলেদের চুল পড়া ঠেকানোর ৯ টি প্রাকৃতিক উপায়ঃ আয়ুর্বেদিক তেল
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ছেলেদের চুল পড়া ঠেকানোর জন্যে অনেকগুলো পদ্ধতির কথা বলা
হয়েছে। এদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় উপায় হচ্ছে আমলা, ভৃঙ্গরাজ, এবং ব্রাহ্মীর
মতো গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের ফল অথবা শুকনো পাতার গুড়ো মেশানো তেল দিয়ে মাথার
ত্বক (Scalp) ম্যাসাজ করা। শাস্ত্রমতে, এই তেলগুলো মাথার ত্বকের পুষ্টি যোগায়,
সেখানে রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে দেয় এবং চুলের গোঁড়াকে শক্ত করে।
উদাহরনস্বরুপ, আমলার তেলে প্রচুর ভিটামিন-সি এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে যা
চুল কে মজবুত করে। ভৃঙ্গরাজ, যাকে ঔষধি গাছদের রাজা বলা হয়ে থাকে, চুল
গজাতে সাহায্য করে এবং চুল পড়া কমিয়ে দেয়। এসকল তেল দিয়ে মাথার ত্বক নিয়মিত
ম্যাসাজ করলে মানসিক চাপও কমে যায় যা চুল পড়া কমাতে সাহায্য করে।
ছেলেদের চুল পড়া ঠেকানোর ৯ টি প্রাকৃতিক উপায়ঃ গ্রিন টি
গ্রিন টি বা সবুজ চায়ের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এর কারনে অনেক দিন ধরেই এটি চাইনিজ কবিরাজি চিকিৎসার একটি
অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে গন্য হয়ে আসছে। গ্রিন টি এর মধ্যে
ক্যাটেকিন্স (catechins)
নামের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আছে যা পুরুষদের টাক গজাতে সাহায্য করে এমন এক
হরমোন DHT
(dihydrotestosterone) কে বাধা দেয়।
এই পদ্ধতিটি ব্যাবহার করার জন্য প্রথমে এক কেটলি গরম পানিতে দুই তিন চামচ
গ্রিন টি মিশিয়ে ফুটিয়ে নিতে হবে, তারপর মিশ্রণটি ঠান্ডা হয়ে গেলে তা দিয়ে
মাথার চুল হাল্কাভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। একঘন্টা পরে পানি দিয়ে মাথা ধুতে হবে। এই
পদ্ধতিটি ব্যবহার করলে চুল পড়া বন্ধই হবে না, বরং চুলের উজ্জ্বলতা বেড়ে যাবে
এবং চুল মজবুত হবে।
ছেলেদের চুল পড়া ঠেকানোর ৯ টি প্রাকৃতিক উপায়ঃ পিঁয়াজের রস
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চুল পড়া ঠেকানোর জন্য পিঁয়াজের রস ব্যাবহার করা হয়।
পিঁয়াজে প্রচুর পরিমান সালফার আছে যা স্বাভাবিক চুল বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
সালফার ত্বকের কোলাজেন (collagen) উৎপন্ন করতে সাহায্য করে যা আবার চুলের
জন্যেও উপকারী ভূমিকা পালন করে।
চুলে পিঁয়াজের রস লাগালে তা চুলের গোড়ায় রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে দিয়ে চুলকে মজবুত
করে এবং চুল গজাতে সাহায্য করে বলে ভাবা হয়। এই পদ্ধতিটি ব্যাবহার করার জন্যে
পিঁয়াজ পিষে তার রস বের করে চুলে লাগাতে হয় এবং ১০-১৫ মিনিট পরে মাথা পানি দিয়ে
ধুয়ে ফেলতে হয়। এভাবে নিয়মিত পেঁয়াজের রস লাগালে চুলের ঘনত্ব বেড়ে যায় এবং চুল
পড়া কমে যায়।
ভুমধ্যসাগরের আশেপাশের দেশগুলোতে ছেলেদের চুল পড়া ঠেকাতে মেথির ব্যাপক ব্যবহার
হয়। মেথি প্রোটিন এবং নিকোটিনিক এসিডে সমৃদ্ধ, এই দুইটি উপাদানের প্রত্যেকটিই
চুলকে বাড়তে সাহায্য করে।
মেথিকে সারারাত পানিতে ডুবিয়ে রেখে, সকালবেলা পানি ফেলে দিয়ে মেথিকে পিষে পেষ্ট
বানিয়ে মাথার ত্বকে লাগানো হয়। অনেকে আরও উপকার পাওয়ার জন্য এর সাথে নারিকেল তেল
মেশায়। এই পদ্ধতিটি চুলের গোঁড়া শক্ত করে এবং খুশকিও দূর করে, যা চুল পড়ার অন্যতম
একটি কারন।
ছেলেদের চুল পড়া ঠেকানোর ৯ টি প্রাকৃতিক উপায়ঃ ঘৃতকুমারী (Aloe Vera)
প্রাচীন মিশরীয়রা ঘৃতকুমারী গাছ ত্বক মসৃন করতে এবং চুল পড়া ঠেকানোর জন্য
ব্যাবহার করত। ঘৃতকুমারী
প্রোটিয়লিটিক এনজাইম এ সমৃদ্ধ যা মাথার ত্বকের মৃত কোষগুলো সারিয়ে তুলে স্বাস্থ্যকর চুল
বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ঘৃতকুমারী গাছের পাতার জেল সরাসরি মাথার ত্বক ও চুলে লাগানো হয়। আধাঘন্টা পর
মাথায় পানি দিয়ে তা ধুয়ে ফেলা হয়। এই পদ্ধতিটি খুশকি কমায়, চুলকে পুষ্ট করে এবং
মাথার ত্বকের এসিডিটি নিয়ন্ত্রন করার মাধ্যমে মাথায় চুল গজানোর একটি ভালো পরিবেশ
সৃষ্টি করে।
ছেলেদের চুল পড়া ঠেকানোর ৯ টি প্রাকৃতিক উপায়ঃ নারিকেলের দুধ
দক্ষিন-পুর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ছেলেদের চুল পড়া ঠেকানোর জন্য নারিকেলের দুধকে
উপকারী মনে করা হয়। নারিকেলের দুধে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি অ্যাসিড (essential fats,
যেমন ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬), প্রোটিন এবং মিনারেল থাকায় এটি মাথার ত্বককে পুষ্টি
যোগায় এবং চুলের গোঁড়াকে শক্ত করে। এছাড়াও নারিকেলের দুধ
লরিক এসিডে
সমৃদ্ধ যা ব্যাক্টেরিয়া এবং ভাইরাস প্রতিরোধ করে মাথার ত্বককে রক্ষা করে।
এই পদ্ধতিতে ফ্রেশ নারিকেলের দুধ দিয়ে মাথার ত্বক ম্যাসাজ করা হয়; ২০-৩০ মিনিট
এভাবে রাখার পর পানি দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলা হয়। এটি চুলকে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করে
প্রানবন্ত রাখে, যা চুলকে ভেঙ্গে পড়া ও পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
ছেলেদের চুল পড়া ঠেকানোর ৯ টি প্রাকৃতিক উপায়ঃ জিন সেং
কোরিয়ান সংস্কৃতিতে জিন সেং কে তার ঔষধী গুনের জন্য অনেক উঁচু চোখে দেখা হয়। একে
প্রায়ই ছেলেদের চুল পড়া ঠেকাতে এবং নতুন চুল গজানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। জিন সেং
এ রয়েছে জিনসেনোসাইডস্ (ginsenosides) যা চুলের গোঁড়াকে শক্ত করে, মাথার ত্বকে
রক্ত সঞ্চালনের উন্নতি ঘটায়, এবং চুলের গোঁড়াদের উজ্জীবিত করে।
কোরিয়ান পুরুষেরা সাধারনত শ্যাম্পু, কন্ডিশনার জাতীয় জিনিসের সাথে জিন সেং
নির্যাস নিয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার চুল পড়া ঠেকানোর জন্য জিন সেং সাপ্লিমেন্টও খেয়ে
থাকে। জিন সেং নিয়মিত ব্যবহার করলে মাথার চুল হাল্কা হয়ে যাবার হার কমিয়ে দেয় এবং
চুলের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয় বলে বিশ্বাস করা হয়।
ছেলেদের চুল পড়া ঠেকানোর ৯ টি প্রাকৃতিক উপায়ঃ জোজোবা তেল (Jojoba Oil)
উত্তর আমেরিকার আদিবাসীরা অনেক দিন ধরেই জোজোবা তেল ব্যাবহার করে আসছে। এই তেল
গঠনের দিক থেকে মাথার ত্বকের উৎপন্ন করা তেলের প্রায় কাছাকাছি। জোজোবা তেল
নানারকম ভিটামিন ও মিনারেল যেমন ভিটামিন-E, B-কমপ্লেক্স ভিটামিন সমূহ, জিঙ্ক ও
কপার দ্বারা পরিপুর্ন আছে।
এই তেল দিয়ে মাথার ত্বক ম্যাসাজ করলে তা চুলকে আর্দ্র করে, চুলের সেবাম (Sebum)
এর গড়ে ওঠাকে বাধা দান করে, এবং চুল গজানোকে উৎসাহিত করে। যেসব পুরুষের মাথার
ত্বক শুস্ক থাকে অথবা যাদের খুশকির সমস্যা আছে তাদের জন্যে এই তেল বিশেষ ভাবে
উপকারী কারন এই তেল মাথার ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং খুশকি কমিয়ে দেয়।
ছেলেদের চুল পড়া ঠেকানোর ৯ টি প্রাকৃতিক উপায়ঃ স পালমেটো নির্যাস
স পালমেটো উত্তর
আমেরিকায় জন্মে থাকা এক ছোট পাম জাতীয় গাছের নাম। প্রচলিতে ভাবে এই গাছের ফল
ছেলেদের চুল পড়া ঠেকানোর জন্যে ব্যাবহার করা হয়। এই ফলে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা
DHT (ছেলেদের টাক গজাতে সাহায্য করে এমন একটি হরমোন) কে বাধাদান করে বলে বিশ্বাস
করা হয়।
ছেলেদের চুল পড়া ঠেকাতে স পালমেটো নির্যাস কে তেল হিসেবে মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করা
যায়, আবার DHT কে বাধা দিতে এবং চুল গজানোর জন্য সাপ্লিমেণ্ট হিসেবেও খাওয়া
যায়। এটি মাথার ত্বকের স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটায় যেটা চুলের ঘনত্ব বজায় রাখার
জন্য অপরিহার্য।
শেষকথা
যদিও ছেলেদের চুল পড়ার পেছনে বংশগত এবং হরমোনাল দিকগুলো গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন
করে, তারপরেও এই আর্টিকেলে বর্নিত প্রাকৃতিক পদ্ধতিগুলো অনুসরন করলে চুলের
স্বাস্থ্য ভালো থাকবে এবং চুল পড়া কমে যাবে। শুধু তাই নয় উপরে বর্নিত পদ্ধতিগুলো
মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং পরিবেশগত কারন থেকে
চুলকে রক্ষা করে।
এইসব প্রাকৃতিক পদ্ধতির ব্যবহার করার সাথে সাথে সুষম খাদ্য গ্রহন করা, নিয়মিত
শারীরিক পরিশ্রম করা এবং চুলের যত্ন নেয়ার মাধ্যমে ছেলেদের চুল পড়া আরও ঠেকানো
যেতে পারে।
আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url