আপনি যেভাবে সারাক্ষণ ক্লান্তি লাগা থেকে মুক্তি পাবেন
বর্তমানের দ্রত গতির পৃথিবীতে আমাদের অনেকেই সবসময় ক্লান্তি বোধ করি এবং কাজ করার শক্তি পাই না। শারীরিক, মানসিক অথবা আবেগগত যে কারনেই হোক না কেন, সারাক্ষন ক্লান্তি লাগা আমাদেরকে আমাদের ভালো থাকতে দেয় না; আমরা আমাদের জীবনকে উপভোগ করতে পারি না।
সৌভাগ্যবশত, সবসময় ক্লান্তি দূর করা এবং আপনার দেহ ও মনকে জাগিয়ে তোলার জন্য বেশ কিছু ভালো উপায় আছে। এই আর্টিকেলে আমরা সারাক্ষন ক্লান্তি লাগা দূর করার জন্য সেরকম নয়টি কার্যকরি উপায় আলোচনা করব।
সুচিপত্রঃ আপনি যেভাবে সারাক্ষন ক্লান্তি লাগা থেকে মুক্তি পাবেন
পরিচ্ছন্ন ঘুমকে প্রাধান্য দিন
রাতে ভালো ঘুম না হওয়া সারাক্ষন ক্লান্তি লাগার অন্যতম প্রধান কারন। ঘুমের
পরিচ্ছনতা বলতে এমন সব অভ্যাসকে বোঝায় যেগুলো মেনে চললে ঘুমের গুনগত মান এবং সময়
বেড়ে যায়। আপনি যেভাবে রাতের বেলায় পরিচ্ছন্নভাবে ঘুমাতে পারেন তা নিচে আলোচনা
করা হলোঃ
নিয়মিত ঘুমের সময়সূচী বজায় রাখুনঃ প্রত্যেকদিন, এমনকি ছুটির দিনেও, একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং জেগে উঠুন। এই
ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে আপনার শরীরের প্রাকৃতিক রুটিন আপনার নিয়ন্ত্রনে চলে
আসবে, যার ফলে আপনে সহজেই ঘুমিয়ে পড়তে পারবেন এবং স্বাভাবিকভাবে জেগে উঠবেন।
এভাবে একটি নিয়মিত ঘুমের সময়সূচী বজায় রাখতে পারলে আপনি ঘুম গভীর ও আরামদায়ক হবে
যা আপনার সামগ্রিক সুস্থ্যতাকে বাড়িয়ে দেবে।
আরামদায়ক রাতের রুটিন তৈরি করুনঃ বই পড়া,
ধ্যান করা, অথবা হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করার মত দেহ ও মনকে শান্ত করার মত কাজ
করার মাধ্যমে বিশ্রাম নেবার জন্য একটি আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করুন। ঘুমানোর সময়ের
কয়েক ঘন্টা আগে থেকে চা-কফি, ধূমপান, এবং চিনিযুক্ত কোমল পানীয়র মত উত্তেজক
পদার্থগুলো এড়িয়ে চলুন; এগুলো আপনাকে ঘুমিয়ে পড়তে বাধা দিবে। আপনার রাতের রুটিনে
এসব বিশ্রাম নেয়ার পদ্ধতিগুলো মেনে চললে আপনার ঘুম ভালো হবে এবং আপনি সহজেই
ঘুমিয়ে যেতে পারবেন।
ঘুমের পরিবেশকে উন্নত করুনঃ আপনার শোবার ঘরকে নিরব, অন্ধকার এবং আরামদায়ক তাপমাত্রায় রাখুন যাতে
ঘুমানোর জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়। প্রয়োজন হলে ঘরে আলো ঢুকতে দেয় না এমন
ব্ল্যাক আউট কার্টেন ব্যাবহার করুন, কানে এয়ার প্লাগ লাগান, এবং দরকার হলে
একটি হোয়াইট নয়েজ মেশিন কিনুন। একটি ভালো মানের বিছানার চাদর এবং আপনার পছন্দ
অনুযায়ী বালিশ ব্যাবহার করলে সারা রাতজুড়েই আপনি ভালোভাবে ঘুমাতে পারবেন।
৭-৯ ঘণ্টার মানসম্পন্ন ঘুম নিশ্চিত করুনঃ পর্যাপ্ত ঘুমের অভ্যাস আপনার এনার্জি লেভেল, মুড, এবং সার্বিক স্বাস্থ্যের
উপর গভীর প্রভাব ফেলে। নিয়মিতভাবে সাত থেকে নয় ঘণ্টা ভালো ভাবে ঘুমালে আপনার দেহ
এবং মন সারা দিনের ক্ষয়ক্ষতি সেরে উঠে উজ্জীবিত হবে। আপনি যদি সারাক্ষন ক্লান্তি
লাগা থেকে মুক্তি পেতে চান তাহলে সময়মতো ঘুমানোকে আপনার দৈনন্দিন জীবনের
বাধ্যতামূলক অংশে পরিণত করতে হবে।
পুষ্টিকর খাবার খেয়ে শরীরে শক্তি যোগান
আপনি প্রতিদিন যে খাবার খান তা আপনার দেহের শক্তি ধরে রাখতে গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা
পালন করে। অপুষ্টিকর এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা উঠানামা
করে, পুষ্টির অভাব হয় এবং সারাক্ষন ক্লান্তি লাগে। যেসব কৌশল অবলম্বন করে খাবার
খেলে আপনি শরীরে সারাদিন ধরে শক্তি পেতে থাকবেন তা নিচে বর্ননা করা হলঃ
সুষম খাবার খানঃ আপনার দৈনন্দিন খাবারে
জটিল শর্করা (যেমন লাল চাল, মসূর ডাল, কচু), কম চর্বিযুক্ত আমিষ (যেমন ছোট মাছ,
দেশি মুরগির মাংস, ছোলা), এবং স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার ( যেমন বাদাম, মাছের
চর্বি, ডিমের কুসুম) রাখার চেষ্টা করুন; এগুলো আপনাকে সারা দিন ধরেই শক্তির যোগান
দিবে। গোটা শস্য, বাদাম, বীজ, এবং শাকসবজি আপনার দেহে পর্যাপ্ত পুষ্টি
যুগিয়ে আপনাকে সারা দিন সজাগ রাখবে।
পর্যাপ্ত পানি পান করুনঃ শরীরে
পানিশুন্যতা সারাক্ষন ক্লান্তি লাগার জন্য একটি সাধারন কারন হলেও আমরা এই
বিষয়টিকে প্রায়ই অবহেলা করে থাকি। পানিশুন্যতা দূর করার জন্য দিন কমপক্ষে
আট কাপ বা দুই লিটার পানি পান করার চেষ্টা করুন; আপনি যদি শারীরিক পরিশ্রম বেশি
করেন অথবা গরম আবহাওয়ায় আপনাকে আরও বেশি পানি পান করতে হতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমান
পানি পান করা শরীর কে ঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে যার ফলে ক্লান্তি দূর হয়ে
আপনি সজাগ থাকবেন।
মিষ্টি খাবার কম করে খানঃ চিনিযুক্ত মিষ্টি খাবার কিছু সময়ের জন্য দেহ ও মনে শক্তি যোগালেও প্রায়ই
অল্প সময়ের মধ্যে সেগুলোর প্রভাব কমে গিয়ে আপনাকে ক্লান্ত করে তোলে। আপনি যদি
সারাদিন ধরে শক্তি বজায় রাখতে চান তাহলে আপনার মিষ্টি আলু, দই, এবং চিনাবাদামের
মত শরীরে সারাদিন ধরে একটু একটু করে শক্তি যোগায় এমন খাবার খাওয়া উচিৎ। এই ধরনের
খাবারগুলো রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে এবং নির্ভরযোগ্য শক্তি সরবরাহ
করতে সাহায্য করে।
শক্তিবর্ধক পুষ্টি গ্রহন করুনঃ সারাক্ষন
ক্লান্তি লাগা থেকে মুক্তি পেতে হলে আপনার দৈনন্দিন খাবার তালিকায় যথেষ্ট পরিমান
আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, এবং বি ভিটামিনযুক্ত খাবার থাকতে হবে যা আপনার শক্তি যোগানোর
জন্য অপরিহার্য। বিভিন্ন প্রকার পাতাযুক্ত শাক, ডাল এবং খাদ্যশস্য এসব পুষ্টিতে
ভরপুর থাকে। এসব উপাদান দিয়ে সমৃদ্ধ খাবার আপনার এনার্জি লেভেল বজায় রাখার
পাশাপাশি আপনার স্বাস্থ্যকেও ভালো রাখে।
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন
এটা শুনতে হয়তো আজব লাগতে পারে, কিন্তু নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ক্লান্তি দূর করতে
পারে। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের ফলে দেহে রক্ত সঞ্চালনের উন্নতি ঘটে যার
ফলে আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও মাংসপেশির টিস্যুগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ
বেড়ে যায়। এছাড়াও শারীরিক পরিশ্রম করলে রক্তে এন্ডোরফিন (Endorphin) নামের
একধরনের হরমোন নিঃসৃত হয় যা দেহের শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি মনকেও ভালো রাখে।
ছোট থেকে শুরু করুনঃ হাঁটা, হালকা
স্ট্রেচিং, এবং যোগব্যায়ামের মতো সহজ কাজগুলো দিয়ে আপনার ফিটনেস যাত্রা শুরু
করুন। ধীরে ধীরে শুরু করলে আপনার দেহ কাজ করার জন্য অভ্যস্ত হতে শুরু করবে যার
ফলে আপনি সহজে ক্লান্ত হবেন না এবং আপনার আঘাত পাওয়ার ঝুঁকিও কমে আসবে। সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে আপনার শক্তি ও সহনশীলতা বাড়তে থাকলে ব্যায়ামগুলোর মাত্রা এবং সময়
বাড়িয়ে দিন।
শক্তি এবং সহনশীলতা বৃদ্ধির ব্যায়াম করুনঃ শরীরের সামগ্রিক শক্তি বাড়ানোর মাধ্যমে সারাক্ষন ক্লান্তি লাগা দূর করতে
হলে রেজিস্ট্যান্স ট্রেইনিং এবং অ্যারোবিক ব্যায়ামের সমন্বয় করা একটা ভালো উপায়
হতে পারে। শক্তি বৃদ্ধির ব্যায়ামগুলো মাংসপেশি গঠন করে এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতা
বাড়ায়, আবার কার্ডিও ব্যায়াম (হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো)
হৃদপিণ্ডকে ভালো রাখে এবং দম ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এই দুই ধরনের
ব্যায়ামগুলো একসাথে করলে আপনার শরীর দীর্ঘমেয়াদে ভালো থাকবে এবং আপনার দেহে
সারাদিন শক্তির যোগান দিয়ে আপনাকে সারাক্ষণ ক্লান্তি লাগা থেকে মুক্তি
দিবে।
নিয়মিত অনুশীলন করুনঃ শারীরিক পরিশ্রম
থেকে দীর্ঘমেয়াদী উপকার পেতে সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন ৩০ মিনিটের মাঝারি ব্যায়াম
করুন। নিয়মিত অনুশীলন দেহের এনার্জি লেভেল বাড়ায়, মন ভালো রাখে, এবং সারা শরীরকেও
সুস্থ্য রাথে। প্রতিদিনের অভ্যাস হিসেবে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ গড়ে তুললে দেহ এবং
মনের স্থায়ী উন্নতি নিশ্চিত করা যায়।
সঠিকভাবে মানসিক চাপ সামলান
গুরুতর মানসিক চাপ আপনার দেহ এবং মনের শক্তি কেড়ে নিয়ে আপনাকে সারাক্ষন ক্লান্ত
করে রাখে। মানসিক চাপের ফলে রক্তে কর্টিসল এবং অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসৃত হয় যা
দেহে উচ্চমাত্রায় দীর্ঘসময় ধরে থাকলে শরীর ভেঙ্গে পড়তে পারে। সারাক্ষন ক্লান্তি
লাগা থেকে মুক্তি পেতে সঠিকভাবে মানসিক চাপ সামলাবার কয়েকটি উপায় নিচে আলোচনা করা
হলোঃ
মননশীলতা অনুশীলন করুনঃ মানসিক চাপ কমাতে
মেডিটেশন, গভীরভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার মতো মনকে শান্ত করার মননশীল পদ্ধতিগুলো
চর্চা করুন। এই পদ্ধতিগুলো চাপ কমাতে সাহায্য করে, শরীরকে শিথিল করে, এবং
পরিস্কারভাবে চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা বাড়ায়। সময়ের সাথে সাথে মননশীলতার চর্চা
দেহ ও মনের ক্লান্তি কমিয়ে এনে আপনাকে সারাক্ষন ক্লান্তি লাগা থেকে মুক্তি দিতে
পারে।
সীমা নির্ধারন করুনঃ যেসব অনুরোধ বা দাবি
পালন করতে গিয়ে আপনাকে নিজের সময় এবং শক্তি প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি ব্যয় করতে
হয়, সেগুলোকে না বলতে শিখুন। আপনার জীবনের লক্ষ্য এবং মুল্যবোধের সাথে মিলে যায়
এমন কাজ এবং দ্বায়িত্বকে অগ্রাধিকার দিন। দৈনন্দিন জীবনে স্পষ্ট সীমা নির্ধারন
করে দিলে আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বেন না এবং আপনার জীবনে আসলেই যে
কাজগুলো গুরত্বপুর্ন সেগুলোতে মনযোগ দেবার সুযোগ পাবেন।
শখের কাজে জড়িয়ে পড়ুনঃ দৈনন্দিন জীবনে যেসব কাজ করতে আপনি ভালোবাসেন (যেমন ছবি দেখা, গান শোনা,
বই পড়া) সেসবের পেছনে অবসর সময়কে কাজে লাগান। শখের কাজগুলো আমাদের নিজেদের
সৃজনশীলতা প্রকাশ করার মাধ্যম হতে পারে; এটি একই সংগে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন
চাপকেও সাময়িক সময়ের জন্য ভুলিয়ে দিয়ে আমাদের মনকে সতেজ করে।
অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করুন
নানারকম চেষ্টা করেও যদি আপনি সবসময় ক্লান্ত বোধ করেন, তাহলে আপনাকে খুব সম্ভবত
একজন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। অনেক সময় শারীরিক ক্লান্তি বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ
রোগের উপসর্গ রপে প্রকাশ পায়। এই কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী যথাযথ
ব্যাবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে আপনি আপনার হারানো শক্তি ফিরে পাবেন এবং আপনার সামগ্রিক
স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটবে। সারাক্ষন ক্লান্তি লাগার কতিপয় শারীরিক কারনগুলো হলঃ
অ্যানিমিয়াঃ রক্তে লোহিত রক্ত কনিকা অথবা
হিমোগ্লোবিনের পরিমান কমে গেলে শরীরের টিস্যুগুলোতে অক্সিজেনের সরবরাহ প্রয়োজনের
চেয়ে কম হয়। এই অক্সিজেনের অভাবের ফলে রোগী সবসময় ক্লান্ত এবং দুর্বল বোধ
করে। অ্যানিমিয়া ভালো করার জন্য দেহের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে এবং
রোগীকে আয়রন সাপ্লিমেণ্ট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন থেতে হতে পারে।
থাইরয়েড জনিত সমস্যাঃ হাইপোথাইরোইডিজম (Hypothyrodism), যে রোগের কারনে থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিকভাবে
কাজ করে না, এর কারনে কোষীয় বিপাকের হার কমে গিয়ে শরীরের শক্তি উৎপাদন
ব্যাহত হয়। এর ফলে রোগী সারাক্ষন ক্লান্তি বোধ করতে থাকে, সবসময় ঘুম লাগার কারনে
সে পরিস্কারভাবে চিন্তা ভাবনা করতে পারে না। এই রোগকে সঠিক ভাবে চিহ্নিত
করা এবং সে অনুযায়ী ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে ঔষধ খেলে দেহের হারানো
শক্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব।
স্লিপ এপনিয়াঃ এই অবস্থায় ঘুমের সময়
বারবার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, যার ফলে রক্তে অক্সিজেন এর মাত্রা কমে আসে
এবং স্বাভাবিক ঘুমে বাধার সৃষ্টি হয়। এর ফলে স্লিপ এপ্নিয়ায় ভোগা রোগীদের প্রায়ই
রাতের ঘুম ভালো হয় না এবং এরা দিনের বেলায় অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করে। লাইফ
স্টাইল পরিবর্তন করে অথবা ঘুমানোর সময় CPAP যন্ত্র ব্যাবহার করে ভালো করে ঘুমানো
যেতে পারে যা সারাক্ষন ক্লান্তি লাগা থেকে রোগীকে মুক্তি দেয়।
ক্রনিক ফেটিগ সিনড্রোমঃ এই জটিল রোগে
আক্রান্ত ব্যাক্তিরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেবার পরেও সবসময় তীব্র ক্লান্তিতে
ভোগে এবং যা অন্য কোন শারীরিক সমস্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কি কারনে এই রোগ
হয় তা এখনও নিশ্চিত না হওয়া গেলেও, অনেক বিজ্ঞানীদের মতে এটি রোগ প্রতিরোধ
সিস্টেমের অস্বাভাবিকতা বা ভাইরাসজনিত সংক্রমনের মত বিভিন্ন কারনে হয়ে থাকতে
পারে। এই অবস্থা থেকে রোগীকে ম্যানেজ করতে হলে প্রায়শই চিকিৎসা, জীবনধারার
পরিবর্তন এবং মানসিক কৌশলের সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন হয়।
স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন
পিসি, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, এবং স্মার্ট ফোনের মত বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলো অতিরিক্ত
ব্যাবহার করলে এগুলো আমাদের দিন রাতের ঘুমের স্বাভাবিক চক্র (Circadian rhythm)
নষ্ট করে এবং আমাদের মস্তিস্ককে অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে ভরে দিয়ে শারিরিকভাবে
সারাক্ষন ক্লান্তি লাগা ভাব আনতে সাহায্য করে। এছাড়াও এসব যন্ত্রের স্ক্রিন দিয়ে
নীল আলো বের হয় যা আমাদের মস্তিস্কে মেলাটোনিন উৎপন্ন করতে বাধা দান করে;
মেলাটোনিন হচ্ছে এক ধরনের হরমোন যা আমাদেরকে রাতের বেলায় ঘুমিয়ে পড়তে
সাহায্য করে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলেঃ
ডিজিটাল ডিটক্স কার্যকর করুনঃ প্রত্যেক
দিন এমন কিছু সময় বাছাই করে রাখুন যখন আপনি স্মার্টফোন, ট্যাবলেট এবং কম্পিউটার
ব্যাবহার করা থেকে বিরত থাকবেন। এভাবে ইচ্ছা করে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে
ডিজিটাল ডিভাইস অতিরিক্ত ব্যাবহার করার ফলে দেহ এবং মনে যে ক্লান্তি আসে তা কমিয়ে
দিয়ে আপনার মনকে বিশ্রাম নেবার সুযোগ দিবে। এভাব চলতে থাকলে, ডিজিটাল ডিটক্সিং
আপনার মনযোগ দেওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিবে, আপনার মুড ভালো রাখবে এবং আপনি
মানসিকভাবে সতেজ বোধ করবেন।
নীল আলো প্রতিরোধি ফিল্টার ব্যাবহার করুনঃ আজকালকার বেশিরভাগ ডিজিটাল ডিভাইসেই নীল আলো বন্ধ করার সেটিংস, অ্যাপ,
এবং বাজারে নীল আলো ফিল্টার করার চশমাও পাওয়া যায়। সুর্য ডূবে যাবার পরে এসব
ফিল্টার ব্যাবহার করে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যাবহার করা আপনার মস্তিস্ককে আরামদায়ক
ঘুমের জন্য প্রস্তুত করতে সাহায্য করে। নিয়মিত নীল আলো প্রতিরোধী ফিল্টার
ব্যাবহার করলে চোখের উপর চাপ কমে যায় এবং রাতের বেলা ভালো ঘুম হয়।
অফলাইন কার্যকলাপে অংশ নিনঃ প্রতিদিন নিয়মিত হাটতে যাওয়া, বই পড়া, অথবা পরিচিত লোকদের সাথে মুখোমুখি
কথা বলার মত অফলাইন কার্যকলাপে অংশগ্রহন করুন। এই কাজগুলো স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে
থাকার থেকে আপানকে একটা সতেজ বিরতি দিবে এবং আশেপাশের মানুষদের সাথে আপনার একটা
অর্থপুর্ন যোগাযোগ গড়ে উঠবে। আপনি আপনার জীবনে এরকম অফলাইন কার্যকলাপগুলোতে আরও
বেশি জড়িয়ে পরলে আপনার পরিস্কারভাবে চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা আরও বেড়ে যাবে এবং
আপনার জীবনে ভারসাম্য বজায় থাকবে।
নিয়মিত বিরতি নিন
নিয়মিত বিরতি না নিয়ে কাজ করতেই থাকলে একসময় আপনার শরীর ক্লান্তিতে ভেংগে পড়বে।
আপনার দৈনন্দিন জীবনে ধারাবাহিকভাবে বিরতি নেওয়া আপনার দেহে শক্তি ধরে রাখা এবং
কর্মক্ষেত্রে আপনার উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। ইচ্ছে করে ছোট ছোট বিরতি
নিলে আপনার দেহ এবং মন সতেজ থাকে যার ফলে দৈনন্দিন কাজগুলোকে খুব একটা কঠিন মনে
হয় না।
পমোডোরো টেকনিক অনুসরন করুনঃ ২৫ মিনিট
অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে কাজ করা এবং তারপর ৫ মিনিট করে বিরতি নেওয়াকে পমোডোরো টেকনিক
বলা হয়। এই পদ্ধতি একটা জটিল কাজকে অনেকগুলো সহজসাধ্য ভাগে করে আমাদেরকে পুরো
কাজটির উপর মনযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে। এর ফলে এটি আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে
দেয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার ফলে আমাদেরকে ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকি
কমায়।
স্ট্রেচ করুন এবং নড়াচড়া করুনঃ দীর্ঘ সময়
ধরে বসে থাকার একঘেয়েমি কাটাতে মাঝে মাঝে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান, শরীরকে প্রসারিত
করুন, এবং হালকা হাঁটাহাঁটি করুন। এর ফলে দেহে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, দেহ
নমনীয় হয়, এবং মন ফ্রেশ থাকে। প্রতিদিনের রুটিনে এরকম ছোট ছোট শারীরিক বিরতি যোগ
করলে মনযোগ এবং সামগ্রিক সুস্থ্যতার উন্নতি ঘটে।
২০-২০-২০ নিয়ম অনুশীলন করুনঃ প্রতি ২০
মিনিট স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার পরে, ২০ ফিট দুরের কোন একটি বস্তুর দিকে ২০
সেকেন্ড তাকিয়ে থাকুন। এই সহজ অনুশীলন অনেকক্ষন ধরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার
ফলে চোখের উপর চাপ কমাতে এবং মানসিক ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। নিয়মিত এই
নিয়ম অনুসরন করলে চোখের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে এবং কাজ করার ক্ষমতা বেড়ে
যায়।
সামাজিকতা বজায় রাখুন
সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকি থাকা আপনার আবেগগত শক্তি (Emotional energy) কেড়ে
নিয়ে আপনাকে মানসিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত করে তুলতে পারে। সঠিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ
বজায় রাখলে প্রয়োজনে মানসিক সমর্থন পাওয়া যায়, এটি মানসিক চাপ কমায়, এবং আমদেরকে
সুখী রাখতে সাহায্য করে। আপনার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, এবং পরিচিত মানুষদের সাথে
নিয়ে একটি সাপোর্ট সিস্টেম গড়ে তুলতে পারলে আপনি মানসিকভাবে ভালো থাকবেন; যার ফলে
আপনি সবসময় ক্লান্তি লাগার একটি অন্যতম প্রধান কারন থেকে মুক্তি পাবেন।
শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখুনঃ পরিবার ও
বন্ধুদের সাথে মানসম্মত সময় কাটান, তাদের সাথে অর্থপুর্ন কথা বলুন, একে অপরের
অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন, এবং একসাথে হাসুন। এই সম্পর্কগুলো গড়ে তোলা এবং লালন করা
আপনাকে পরিবার এবং সমাজে নিজের গুরুত্ব সম্পর্কে আপনাকে সচেতন করবে। এভাবে
ব্যাক্তিগত জীবনে সম্পর্কগুলো ভালোভাবে বজায় রাখতে পারলে আপনি সুখী হবেন; একজন
সুখী মানুষ শারীরিক ও মানসিক চাপকে চমৎকারভাবে মোকাবেলা করতে জানে।
সামাজিক গ্রুপে যোগ দিনঃ সমমনা মানুষদের খুঁজে পেতে এবং তাদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতে চাইলে আপনি
আপনার ইন্টারেস্ট অনুযায়ী বিভিন্ন ক্লাবে যোগ দিতে পারেন, বিভিন্ন সামাজিক
অনুষ্ঠান এবং দুর্যোগ পরবর্তি সময়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে পারেন। এভাবে
গ্রুপ কার্যক্রমে অংশ নিলে আপনি নতুন নতুন মানুষদের সাথে মিশতে পারবেন; এতে আপনার
সামাজিক জানাশোনার পরিধিও বেড়ে যাবে। সময়ের সাথে সাথে এগুলো আপনার আত্মবিশ্বাস
বাড়িয়ে দিয়ে আপনার ব্যাক্তিগত উন্নয়নের সু্যোগ তৈরি করে দিবে।
পেশাদার সাহায্য নিনঃ আপনি যদি সামাজিক
উদ্বেগ (Social anxiety) বা মানসিক বিষন্নতায় ভোগার কারনে সমাজের লোকদের সাথে
ভালোভাবে মিশতে পারছেন না, তাহলে আপনি থেরাপি অথবা কাউন্সিলিং এর বিষয়টি বিবেচনা
করুন। একজন পেশাদার থেরাপিষ্ট আপনার সাথে কথা বলে আপনার জীবনের চ্যালেঞ্জগুলি
কাটিয়ে উঠতে এবং সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে মূল্যবান উপদেশ এবং কৌশল প্রদান করতে
পারে। সঠিক সহায়তার ফলে, আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটিয়ে আপনাকে সমাজের
একজন স্বাভাবিক সদস্য হিসেবে গড়ে তোলা যাবে।
ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখুন
আপনার জীবন ও কাজকে আপনি কি দৃষ্টীতে দেখেন তা আপনার শরীরের শক্তির মাত্রাকে
উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। নেতিবাচক চিন্তাধারা মানসিক চাপ এবং
ক্লান্তি বাড়িয়ে দিতে পারে, অন্যদিকে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা আপনার সহনশীলতা এবং
ভালোভাবে কাজ করার জন্য আপনাকে প্রেরনা যোগাবে। আবার ইতিবাচক মনোভাব নিজের মধ্যে
একধরনের ক্ষমতা প্রদান করে, যার ফলে সহজেই ক্লান্তি দূর করা যায়।
কৃতজ্ঞতা অনুশীলন করুনঃ প্রতিদিন কয়েক
মিনিট সময় নিয়ে তিনটি বিষয় লিখে রাখুন যার জন্য আপনি কৃতজ্ঞ বোধ করে থাকেন। এই
সহজ অভ্যাসটি ক্লান্তি বা নেতিবাচক চিন্তাধারা থেকে আপনার মনকে সরিয়ে এনে জীবনের
ভালো জিনিসগুলোর দিকে আপনাকে মনযোগ দিতে সাহায্য করে। নিয়মিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের
অনুশীলনটি করে থাকলে আপনার আবেগিয় ভারসাম্য বজায় থাকে এবং দেহের এনার্জি লেভেলও
বেড়ে যায়।
নিজের সফল হওয়া কল্পনা করুনঃ আপনি জীবনে
যে পর্যায়ে যেতে চান, যেরকম জীবন পেতে চান, জীবনে যে লক্ষ্য অর্জন করতে চান তা
মনে মনে কল্পনা করুন। এই মানসিক অনুশীলন আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে, নিজের
সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ দূর করবে, এবং জীবনে আরও ভালো কিছু করার জন্য আপনাকে
অনুপ্রেরনা যোগাবে। ধারাবাহিকভাবে নিজের সাফল্য কল্পনা করা আপানকে ভবিষ্যতের জন্য
আশাবাদী মনোভাব তৈরি করে এবং "আমি পারি" মনোভাবকে শক্তিশালী করতে সাহায্য
করে।
নিজের প্রতি সদয় হনঃ জীবনে কঠিন সময় বা বাধার মুখোমুখি হলে নিজের প্রতি সদয় হন এবং
সহানুভূতিশীল মনোভাব বজায় রাখুন। আপানকে বুঝতে হবে ভুল করা একটি স্বাভাবিক বিষয়
এবং অতিরিক্ত আত্ম সমালোচনা আপনার মানসিক শক্তি কেড়ে নিয়ে আপনাকে দুর্বল করে
দিবে। নিজেকে ক্ষমা করতে পারা আপনাকে মানসিক ভাবে শক্ত করে যার ফলে আপনি জীবনের
সমস্যাগুলো সহজে মোকাবেলা করতে পারবেন।
শেষ কথা
সারাক্ষন ক্লান্তি লাগা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব কোন কিছু নয়। এই আর্টিকেলে
বর্নিত পদ্ধতিগুলো আপনার জীবনে প্রয়োগ করে আপনি সহজেই আপনার দেহে শক্তি ধরে রাখতে
এবং আপনার মনে প্রান সঞ্চার করতে পারবেন।
সবশেষে বলা যায়, সঠিকভাব জীবন যাপন করা এবং দেহের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো চিহ্নিত
করা ও সেগুলো যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলার মাধ্যমে আপনি সারাক্ষন
ক্লান্তি লাগা থেকে মুক্তি পাবেন। এসব অভ্যাস আপনার ক্লান্তি দূর করে আপনাকে একটি
পরিপুর্ন এবং স্বাস্থ্যকর জীবন উপভোগ করতে দিবে ।
আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url