পারমানবিক বিস্ফোরণ থেকে বাঁচার উপায়
বর্তমান পৃথিবীর ভুরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুদ্ধ, দুর্ঘটনা অথবা সন্ত্রাসী হামলার কারনে পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। একটি পারমানবিক বিস্ফোরনের ফলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ এবং ধুলিকনা বাতাসের সাথে ভেসে বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
পারমানবিক বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে থাকতে হলে আপানকে যথাযথ প্রুস্তুতি নিতে হবে, প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস জানতে হবে, এবং দ্রুত কাজ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। এই আর্টিকেলে পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটার আগে, ঘটার সময়, এবং ঘটার পর কি করলে আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি হবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
সুচিপত্রঃ পারমানবিক বিস্ফোরণ থেকে বাঁচার উপায়
নিউক্লিয়ার ফল আউট কি?
একটি পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটার পরে বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় কনার বাতাসে ছড়িয়ে পরার
ঘটনাকে নিউক্লিয়ার ফল আউট বলা হয়। এই কণাগুলো তাদের রাসায়নিক গঠন অনুসারে কয়েক
সপ্তাহ থেকে শুরু করে কয়েক বছর পর্যন্ত মানুষ এবং জীবিত পশুপাখি ও গাছপালার জন্য
বিপদজনক হতে পারে। ফল আউটের ফলে কোন একটি এলাকার বাতাস, পানি, মাটি এবং খাবার
তেজস্ক্রিয় ধুলিকনা দিয়ে দূষিত হবার ফলে ঐ এলাকায় বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে
যায়।
ফল আউটের তাৎক্ষণিক বিপদ হলো তেজস্ক্রিয়তা, যা তেজস্ক্রিয়া জনিত
তীব্র অসুস্থতা, ক্যান্সার, এবং অন্যান্য গুরুতর প্রানঘাতী রোগের কারন
হতে পারে। নিউক্লিয়ার ফল আউটের সময় আপনার অবস্থান, বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা থাকার
সময়কাল, এবং আপনি তেজস্ক্রিয়তা থেকে বাঁচার জন্য কি রকম সুরক্ষা গ্রহন করেছেন তার
উপর আপনার বেঁচে থাকা নির্ভর করবে। এসব ঝুঁকিগুলো জানা থাকলে আপনি নিজে এবং আপনার
পরিবারকে বাঁচানোর জন্য আগেভাগে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
পারমানবিক ঘটনার পূর্বপ্রস্তুতি
১। একটি প্ল্যান তৈরি করুনঃ পারমানবিক
বিস্ফোরণ থেকে বাঁচতে চাইলে প্রথমেই আপনাকে একটি পরিস্কার পরিকল্পনা করে
প্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে। একটি পারমানবিক ঘটনার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে এবং তা
কিভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে আপনার পরিবার বা বাড়ির সদস্যদের সাথে আলোচনা
করুন। আপনার বাড়ি বা পাড়ার নিরাপদ স্থানগুলো চিহ্নিত করুন; যদি পরিবারের অন্য
সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে সেক্ষেত্রে আগেভাগেই একে অপরের
সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করুন।
২। আশ্রয় নেবার জায়গা খুঁজে রাখুনঃ পারমানবিক বিস্ফোরণ থেকে বাঁচার জন্য সঠিক আশ্রয়ের কোন বিকল্প নেই। এই
জন্য আপনার বাড়ির কাছে, আপনি যেখানে কাজ করেন, অথবা আপনি যেখানে প্রায়ই যাতায়াত
করেন এমন জায়গাগুলোতে আপনাকে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বের করে নিতে হবে। বাড়ির
বেইজমেণ্ট (যদি থেকে থাকে), ভুগর্ভস্থ পার্কিং গ্যারাজ, অথবা কংক্রিট বা ইটের মতো
শক্ত উপাদান দিয়ে বানানো বিল্ডিং নিউক্লিয়ার ফল আউট থেকে বাঁচার জন্য আদর্শ স্থান
হতে পারে।
৩। পর্যাপ্ত সরবরাহ মজুদ করুনঃ পারমানবিক বিস্ফোরণের পর আপনি যদি দীর্ঘমেয়াদে বেঁচে থাকতে চান তবে আপনার
কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ জিনিস মজুদ থাকতে হবে। আপনার সাথে যেই জিনিসগুলো থাকা উচিৎ,
সেগুলো হলঃ
- শুকনো, সহজে নষ্ট হয় না এমন খাবার এবং বোতলজাত পানি (প্রতি ব্যাক্তির জন্য কমপক্ষে দুই সপ্তাহের জন্য)
- ব্যাটারি চালিত বা হাত চালিত রেডিও
- প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম
- পটাসিয়াম আয়োডাইড ট্যাবলেট (থাইরয়েড গ্রন্থিকে তেজস্ক্রিয় আয়োডিন থেকে রক্ষা করতে)
- জানালা ও দরজা সিল করার জন্য প্লাস্টিক শিট এবং ডাক্ট টেপ
- প্রতিরক্ষামূলক পোশাক, মাস্ক এবং গ্লাভস
- ব্যাক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার সামগ্রী
- একটি মাল্টি টুল এবং ম্যানুয়াল ক্যান ওপেনার
৪। সচেতন থাকুনঃ মানবদেহে তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানুন এবং সংবাদপত্র,
টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেটে পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এমন সব ঘটনা নিয়ে
চোখ কান খোলা রাখুন। আপনি যেখানে বসবাস করেন সেই এলাকায় সরকার থেকে সরবরাহ করা
বিভিন্ন জরুরী সতর্ক বার্তার সাথে নিজে এবং পরিবারের সদস্যদের পরিচিত করান।
প্রয়োজনে মোবাইল ফোনে সতর্ক করার অ্যাপ ইন্সটল করুন অথবা রিয়েল টাইম
আপডেট পেতে বিভিন্ন খবরের অ্যাপ ব্যাবহার করুন।
৫। অনুশীলন করুনঃ আপনার পরিবার বা দলের সাথে নিয়মিত পারমানবিক বিস্ফোরণের সময় কি করে
নিরাপদ থাকা যায় সে ব্যাপারে অনুশীলন করুন। এর ফলে তারা সহজেই জরুরী অবস্থায়
তাদের কি করতে হবে তা বুঝতে পারবে। নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা, দরজা এবং জানালে দ্রত
বন্ধ করা, এবং সঠিকভাবে জরুরী সরঞ্জাম ব্যাবহার করতে শেখার উপর অনুশীলনে জোর
দেওয়া উচিৎ।
পারমানবিক ঘটনার সময় করনীয়
১। বিপদ সংকেতগুলো বুঝুনঃ আপনি যেখানে
বসবাস করেন তার আশেপাশে পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা থাকলে তার বিপদ সংকেত
আপনি নানা রকম উপায়ে (যেমন সাইরেন বাজানোর মাধ্যমে, টিভিতে জরুরী খবর, মাইকে
ঘোষনা ইত্যাদি ) পেতে পারেন। পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটলে আপনি যদি বিস্ফোরণের
স্থান থেকে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান করেন তাহলে আপনি একটি চোখ ধাঁধানো সাদা আলোর
ঝলক দেখবেন, যাকে নিউক্লিয়ার ফ্ল্যাশ (Nuclear Flash) বলা হয়। এটি দেখলে
আপনাকে সংগে সংগে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে।
২। তৎক্ষণাৎ আশ্রয় নিনঃ পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটার সময় আপনি যদি বাহিরে থাকেন, সংগে সংগে মাটিতে
বুকের উপর ভর করে শুয়ে পড়ুন এবং আপনার চোখ মুখ ঢেকে রাখুন। নিউক্লিয়ার
ফ্ল্যাশের দিকে তাকাবেন না, এটি আপনাকে সাময়িক সময়ের জন্য বা চিরতরে অন্ধ করে
দিতে পারে। শকওয়েভ পুরোপুরি চলে না যাওয়া পর্যন্ত শুয়েই থাকুন; এটি চলে যেতে
কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগতে পারে।
৩। দ্রত আশ্রয় খুজুনঃ পারমানবিক বিস্ফোরণ থেকে বাঁচার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপানকে নিরাপদ
আশ্রয়ে যেতে হবে। পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটার কয়েক মিনিটের মধ্যে বাতাসে
তেজস্ক্রিয় ধুলিকনা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তাই যথাযথ সময়ে আশ্রয় খুঁজে না পেলে
আপনি মারাত্বক বিপদে পড়ে যাবেন। তেজস্ক্রিয়া থেকে বাঁচার জন্য মাটির নিচে ঘর
অথবা জানালাবিহীন, মোটা দেয়াল দিয়ে বানানো ভবন সবচেয়ে ভালো আশ্রয় হতে পারে।
এরকম নিরাপদ আশ্রয়ে প্রবেশ করতে পারলে, তেজস্ক্রিয় ধুলিকনা থেকে নিজেকে
রক্ষা করার জন্য ঘরের মাঝখানে অথবা ভবনের সবচেয়ে নিচের স্তরে অবস্থান
করুন।
৪। আশ্রয় সিল করুনঃ নিউক্লিয়ার ফলআউট থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইলে, আপানকে আপনার আশ্রয়কে
ভালোভাবে সিল করে দিতে হবে। তেজস্ক্রিয় ধূলিকণা যাতে আপনার ঘরে প্রবেশ না করতে
পারে এজন্য আপনাকে সকল দরজা, জানালা, ভেন্টিলেটর বন্ধ করে সেগুলো প্লাস্টিকের
শিট এবং ডাক্ট টেপ দিয়ে সিল করে দিতে হবে। এছাড়াও ঘরের সকল ফ্যান, এয়ার
কন্ডিশনার, এবং হিটিং সিস্টেম বন্ধ রাখতে হবে কারন এগুলো চালিয়ে রাখলে দূষিত
বাতাস আপনার ঘরে প্রবেশ করবে।
৫। আপডেট পর্যবেক্ষন করুনঃ নিউক্লিয়ার ঘটনা চলাকালীন সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে আপনাকে আপনার
চারপাশের পরিবেশে কি হচ্ছে তা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। একটি ব্যাটারি চালিত বা
হাত চালিত রেডিও ব্যাবহার করে আপনি জরুরী বার্তা এবং কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে
পরিস্থিতি নিয়ে আপডেট পেতে পারেন। এই আপডেটগুলো আপনাকে বাহিরের তেজস্ক্রিয়তার
মাত্রা জানাতে পারে, নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সরকারের আদেশ জানাতে পারে এবং
আপানকে আরও অধিক নিরপত্তা ব্যাবস্থা গ্রহন করার ব্যাপারে উপদেশ দিতে
পারে।
পারমানবিক ঘটনার পর বেঁচে থাকা
১। ভেতরে থাকুনঃ পারমানবিক বিস্ফোরণ
ঘটার পরে পরিবেশে তেজস্ক্রিয়তা বিপদজ্জনক ভাবে বেড়ে যাওয়ার কারনে আপনাকে আপনার
নিরাপদ আশ্রয়ে কমপক্ষে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে হতে পারে। এই সময়ের
মধ্যে তেজস্ক্রিয় ধুলিকনাগুলো বাতাস থেকে পড়তে শুরু করবে এবং এগুলোর
তেজস্ক্রিয়তা ক্ষয় হয়ে নিরাপদ লেভেলে চলে আসবে। এর আগে যদি আপনি বাহিরে যান,
তবে আপনি প্রচন্ড মাত্রায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে
আসবেন যা আপনাকে মারাত্বকভাবে অসুস্থ্য করে দিবে; এর ফলে আপনি মারাও যেতে
পারেন।
২। নিজেকে দূষণমুক্ত করুনঃ নিউক্লিয়ার ফল আউটের সময় আপনি যদি বাহিরে অবস্থান করে থাকেন তাহলে
নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছার পরে আপনি যে কাপড় এবং জুতো পড়ে আছেন তা খুলে দিয়ে সেগুলো
একটি প্লাস্টিক ব্যাগে সিল করে রাখুন। সাবান এবং পানি দিয়ে খুব ভালো করে
আপনার পুরো শরীর ধুয়ে ফেলুন। চুলে কন্ডিশনার ব্যাবহার করা থেকে বিরত থাকুন, এটি
আপনার চুলে তেজস্ক্রিয় ধুলিকনা আটকে রাখতে পারে।
৩। পরিমিতভাবে সাপ্লাই ব্যাবহার করুনঃ আপনার খাবার এবং পানির সাপ্লাই খুব সাবধানতার সাথে পরিমিতভাবে ব্যাবহার
করুন যাতে আপনি বিস্ফোরণ পরবর্তী জরুরী অবস্থায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি পান। যেসব
খাবারের আগে নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে আগে সেগুলো খান, শুকনো খাবারগুলো
ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিন। তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে আসা সকল খাবার এবং
পানি বর্জন করুন।
৪। তেজস্ক্রিয়তা প্রতিরোধ করুনঃ পারমানবিক বিস্ফোরণের পরে আপনার শরীরের থাইরয়েড গ্রন্থি যাতে বিষাক্ত
তেজস্ক্রিয় আয়োডিন আইসোটোপ শোষন করতে না পারে সেজন্যে আপনাকে পটাসিয়াম আয়োডাইড
ট্যাবলেট খেতে হবে। এই ট্যাবলেটগুলো নিরাপদ মাত্রায় নিয়মিত গ্রহন করুন, লক্ষ্য
রাখুন আপনি যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত না খান। সম্ভব হলে, পারমানবিক ঘটনা ঘটার
অনেক আগে পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে আপনি নিজে রিসার্চ করে একে সঠিক ভাবে ব্যাবহার
করা এবং আপনার স্বাস্থ্যের উপর এটি কি প্রভাব ফেলতে পারে তা জানুন।
৫। নিরাপদ হলে ঘরে আলো বাতাস ঢুকতে দিনঃ পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটার কয়েকদিন পর আপনার আশেপাশের পরিবেশে
তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কমে আসতে শুরু করবে। আপনার কাছে যদি তেজস্ক্রিয়তা মাপার
যন্ত্র থেকে থাকে তবে তা ব্যাবহার করে নিশ্চিত হন যে বাহিরের পরিবেশ আপনার
আশ্রয়ের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ। যদি তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নিরাপদ সীমার মধ্যে থাকে
তাহলে অল্প সময়ের জন্য আপনার ঘরের দরজা জানালা খুলে রাখুন যাতে ঘরে আলোবাতাস
চলাচল করে।
৬। নিরাপদ এলাকায় চলে যাবার পরিকল্পনা করুনঃ নিউক্লিয়ার ফল আউটের তীব্রতার উপর নির্ভর করে কর্তৃপক্ষ আপনি এবং
আপনার পরিবারকে আপনাদের এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে, অথবা আপনাকে আরও
নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে বলতে পারে। তাদের নির্দেশ যথাযথ ভাবে মেনে চলুন, এবং
আপনার এলাকা থেকে চলে যাবার সময় প্রয়োজনীয় জিনিস আপনার সাথে নিয়ে নিন। উচ্চ
তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা রয়েছে এমন এলাকা এড়িয়ে চলুন।
দীর্ঘমেয়াদে বেঁচে থাকা এবং পুনরুদ্ধার
১। পরিবেশ মুল্যায়ন করুনঃ পারমানবিক বিস্ফোরণের পর তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা সময়ের সাথে উল্লেখযোগ্য
হারে কমে আসতে শুরু করবে, কিন্তু কিছু কিছু এলাকায় ব্যাপক হারে তেজস্ক্রিয়
পদার্থ এবং ধুলিকনা জমা হবার ফলে সেগুলো বছরের পর বছর বিপদজনক হতে পারে। বাহিরে
বের হবার আগে গাইগার কাউন্টার অথবা ডসিমিটারের মত তেজস্ক্রিয় মাপার যন্ত্র
ব্যাবহার করে আপনার এলাকার তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা সঠিকভাবে মেপে নিন। যন্ত্রে
যেসব জায়গায় বেশি তেজস্ক্রিয়তা দেখায় সেসব এলাকা এড়িয়ে চলুন, কেননা
তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে দীর্ঘ সময় কাটানো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক
ক্ষতিকর।
২। চিকিৎসা খুঁজুনঃ সামান্য সময়ের জন্যও তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসা আপনার স্বাস্থ্যের
জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারন হতে পারে, যার ফলে আপনাকে সুযোগ পেলেই চিকিৎসকের
কাছ থেকে শারীরিক অবস্থা পরিক্ষা করে নিতে হবে। তেজস্ক্রিয়তা জনিত অসুস্থ্যতার
লক্ষনগুলো (যেমন বমি ভাব, ক্লান্ত লাগা এবং চামড়া পোড়া) সংগে সংগে প্রকাশ নাও
পেতে পারে, কিন্তু রোগীকে তাৎক্ষনিক চিকিৎসা দিতে হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে
শুরু করলে ডাক্তার বা ইমার্জেন্সি রেস্পন্ডারদের সাথে যোগাযোগ করুন যাতে তারা
আপনার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষন করতে পারে এবং প্রয়োজনে সঠিক চিকিৎসা প্রদান
করতে পারে।
৩। টেকসই জীবন যাপন করুনঃ পারমানবিক ঘটনার পরে আপনি যদি দৈনন্দিন জীবনে ফিরতে না পারেন, তাহলে
আপনি টেকসই ভাবে বাঁচার উপর জোর দিন। আপনি তেজস্ক্রিয়তায় দূষিত হয়নি এমন জমিতে
চাষাবাদ শুরু করতে পারেন, দূষিত পদার্থ অপসারণ করে পানি বিশুদ্ধ করতে পারেন,
এবং নিজের পরিবারের জন্য নিরাপদ, মজবুত আশ্রয় গড়ে তুলতে পারেন। নিউক্লিয়ার ফল
আউট পরবর্তী পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদে বেঁচে থাকতে হলে এসব কাজে দক্ষতা অর্জনের কোন
বিকল্প নেই।
৪। সমাজ পুনর্গঠনে অংশ নিনঃ নিউক্লিয়ার ফল আউট এর পরে সমাজ পুনর্গঠন একটি সমষ্টিগত প্রক্রিয়া হওয়ার
ফলে এটি করতে হলে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে একে অপরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে
হবে। আপনার সমাজের লোকজনদের সাথে একসাথে মিলে গুরুত্বপুর্ন অবকাঠামো পুনর্নিমান
করুন, সাহায্য ও সম্পদ সমানভাবে ভাগাভাগি করুন, এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন,
অসহায়, পঙ্গু মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে আসুন। সবাই মিলে একসাথে সমাজ পুনর্গঠনে
অংশ নিলে খুব দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে।
৫। ভবিষ্যতে প্রস্তুত থাকার জন্য সচেতনতা তৈরি করুনঃ পারমানবিক বিস্ফোরণের পর আপনি বেঁচে থাকলে আপনার অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে
শেয়ার করুন যাতে তারা ভবিষ্যতের পারমানবিক ঘটনার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে। যদি
সম্ভব হয় তাহলে সরকার এবং নীতিনির্ধারকদের এমন কৌশলকে সমর্থন দিতে উৎসাহিত করুন
যা জননিরাপত্তা বাড়ায় এবং ভবিষ্যতে পারমানবিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি হ্রাস করে।
মানসিক শক্তির গুরুত্ব বুঝুন
পারমানবিক বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে যাওয়া একটি গুরুতর মানসিক চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
এই ঘটনা থেকে সৃষ্ট মানসিক চাপ থেকে উদ্বেগ, বিষন্নতা, এবং পোষ্ট-ট্রমাটিক
স্ট্রেস্ ডিসঅর্ডার (PTSD) এর মতো জটিলতার জন্ম হতে পারে। সুতরাং বেঁচে থাকা
এবং উদ্ধার পাওয়ার জন্য মানসিকভাবে ভালো থাকা অপরিহার্য।
১। ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখুনঃ বিপদের
সময় এমন সব কাজে মনযোগ দিন যা আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে রক্ষা করতে সাহায্য
করবে। আপনার নিয়ন্ত্রনে আছে এমন সব জিনিসের দিকে আপনার মনযোগকে ব্যাস্ত রাখতে
পারলে আপনি অসহায়বোধ করবেন না, একই সাথে আপনি মানসিকভাবেও স্থির থাকবেন। আপনি
এবং আপনার পরিবারের সবচেয়ে খারাপ যেসব পরিস্থিতি হতে পারে, এরকম নেতিবাচক
চিন্তাগুলো এড়িয়ে চলুন; কারন এরকম নেতিবাচক চিন্তাগুলো আপনার উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে
দিবে যার ফলে আপনার পরিস্কারভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা ব্যাহত হবে।
২। একে অপরকে সহায়তা করুনঃ আপনি আপনার পরিবার এবং আশেপাশের মানুষদের সাথে খোলামেলা যোগাযোগ বজায়
রাখলে পারমানবিক বিস্ফোরণের মত কঠিন সময় পার করার জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি
পাবেন। আপনার চিন্তা ভাবনা এবং অনুভূতিগুলোকে নিজের মনে চেপে না রেখে অন্যদের
সাথে শেয়ার করলে আপনার উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তাগুলো আপনা আপনিই কমে যাবে। একসাথে
কাজ করা এবং একে অন্যকে উৎসাহ দেবার মাধ্যমে আপনি সমষ্টিগতভাবে শক্তিশালী হবেন
যা আপনাকে কঠিন সময় পার করতে সাহস যোগাবে।
৩। নিজের যত্ন নিনঃ পারমানবিক বিস্ফোরণ পরবর্তী কঠিন সময় মোকাবেলা করতে হলে আপনাকে আপনার
শরীর এবং মনকে ভালো রাখতে হবে। সঠিক এনার্জি লেভেল বজায় রাখার জন্য আপনাকে
নিয়মিত খেতে হবে, পানি পান করতে হবে, এবং যতদূর সম্ভব বিশ্রাম নিতে হবে। নিজের
ভালো থাকাকে প্রাধান্য দিলে আপনি সতর্ক থাকতে পারবেন এবং দুর্যোগ পরবর্তী
চ্যালেঞ্জগুলো ভালোভাবে সামলাতে পারবেন।
তেজস্ক্রিয়তা জনিত রোগের লক্ষনগুলো
একিউট রেডিয়েশন সিকনেস (ARS), যাকে তেজস্ক্রিয়তা জনিত বিষাক্ততাও বলা হয়ে থাকে,
তা অল্প সময়ে মানবদেহে উচ্চ মাত্রার আয়োনাইজিং রেডিয়েশন প্রবেশের কারনে ঘটে
থাকে। এই রোগের চিহ্ন এবং উপসর্গগুলো তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা, কত সময় ধরে
তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসা হয়েছে, এবং দেহের কোন অংশ তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে
এসেছে তার উপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। ARS সাধারনত কয়েকটি পর্যায়ে
বিকাশ লাভ করেঃ
১। প্রাথমিক পর্যায় (প্রাথমিক লক্ষনগুলো) ঃ এই লক্ষণগুলো তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রকাশ
পায় এবং এগুলো কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এগুলো
হলঃ
- বমি ভাব এবং বমি করা ( প্রায়ই তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসার কয়েক ঘণ্টা পর ঘটে থাকে)
- ডাইরিয়া
- অবসাদগ্রস্ত হওয়া এবং দুর্বল বোধ করা
- মাথাব্যাথা করা
- খাবার রুচি চলে যাওয়া
- জ্বর আসা
২। গোপন বা সুপ্ত পর্যায়ঃ প্রাথমিক
লক্ষনগুলো সেরে গেলে, কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক সপ্তাহের জন্য একটি সাময়িক সুস্থতার
সময় দেখা যেতে পারে।
৩। তীব্র অসুখের পর্যায়ঃ শরীরে
তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এবং এর ফলে আক্রান্ত অঙ্গের ক্ষতির উপর নির্ভর করে এই
পর্যায়ে লক্ষণগুলো আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। এগুলো হলঃ
- হেমাটোপয়েটিক সিনড্রোম (বোন ম্যারো আক্রান্ত হয়) ঃ
- রক্তে লোহিত রক্ত কনিকা, শ্বেত রক্ত কনিকা এবং প্লাটিলেট কমে যায়
3. চামড়ার
বিভিন্ন অংশ কেটে গিয়ে রক্ত বের হতে থাকে
- গ্যাস্ট্রোইন্টেসটিনাল সিনড্রোম ( উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয়তায়)ঃ
- প্রচন্ড বমি ভাব এবং বমি করা
2.
রক্তযুক্ত ডাইরিয়া হওয়া
3.
পানিশুন্যতায় ভোগা
4.
রক্তে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া
- নিউরোভাস্কুলার সিনড্রোম (অতি উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয়তায়)ঃ
- অস্থিরতা বোধ করা এবং বিভ্রান্ত হওয়া
2. মাথা
ঘোরা
3. জ্ঞান
হারানো
4.খিঁচুনি
5.
কোমা
৪। সুস্থতা বা মৃত্যু ঃ যদি
তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা প্রানঘাতী না হয় এবং আক্রান্ত ব্যাক্তির রোগ প্রতিরোধ
ক্ষমতা শক্তিশালী হয়, তবে সুচিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ্য করা সম্ভব।
আবার, রোগী উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয়তা গ্রহন করলে এবং এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলে রোগীর মারা যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
সাধারন লক্ষনগুলো
- মাথার চুল পড়ে যাওয়া
- তেজস্ক্রিয়তার ফলে ত্বক পুড়ে যাওয়া
- শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া ঝরে পড়া এবং ঐ সকল স্থানে ঘা হওয়া
- প্রচন্ড ক্লান্তি লাগা এবং অবসাদ বোধ করা
তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা অনুযায়ী তীব্রতা
- নিম্ন মাত্রা (১-২ Gray) ঃ হালকা বমি বমি ভাব, বমি করা, এবং রক্তে সামান্য পরিবর্তন আসা।
- মধ্যম মাত্রা (২-৬ Gray) ঃ গুরুতর বমি করা, মাথার চুল পড়ে যাওয়া, এবং হেমাটোপয়েটিক সিনড্রোমগুলো প্রকাশ পাওয়া।
- উচ্চ মাত্রা (৬-১০ Gray) ঃ এই পর্যায়ে এসে গ্যাস্ট্রোইন্টেসটিনাল সিনড্রোমগুলো প্রকাশ পেতে থাকে এবং রোগীর মারা যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
-
অত্যন্ত উচ্চ মাত্রা (> ১০ Gray) ঃ নিউরোভাস্কুলার সিনড্রোম, রোগী দ্রুত গুরুতরভাবে অসুস্থ্য হতে
থাকে এবং বেশিরভাগ সময়েই রোগীর মৃত্যু ঘটে।
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ সনাক্তকরন এবং দ্রত চিকিৎসার (যেমন অ্যান্টি-বায়োটিক
প্রয়োগ করা, রক্ত দান করা, এবং বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন করা) মাধ্যমে রোগীর
বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ানো যায়।
শেষ কথা
পারমানবিক বিস্ফোরণ এবং নিউক্লিয়ার ফল আউট থেকে বাঁচার জন্য পুর্ব প্রস্তুতি,
তাৎক্ষনিক কাজ করার ক্ষমতা, এবং দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার মনোভাব এই তিনটি
জিনিসের সমন্বয় প্রয়োজন। পারমানবিক বিস্ফোরণ পরবর্তী ঝুঁকিগুলো বুঝতে পারা
এবং সেগুলো মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার মাধ্যমে আপনার ও
আপনার পরিবারের বেঁচে থাকার সুযোগ বাড়াতে পারেন।
সবশেষে, পারমানবিক বিস্ফোরণ একটি ভয়াবহ ঘটনা হলেও, এর জন্য আগে থেকে শারীরিক,
মানসিক, এবং বৈষয়িক ভাবে প্রস্তুত থাকা আপনার এবং আপনার সমাজের লোকদের এমন
চ্যালেঞ্জ আত্মবিশ্বাস এবং নির্ভয়ে মোকাবেলা করতে সাহস যোগাবে।
আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url