নিকট ভবিষ্যতে যে সকল চাকুরিকে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা খেয়ে নিতে পারে

 

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং অটোমেশনের উদ্ভাবন এবং বাস্তব জীবনে এদের প্রয়োগ বৈশ্বিক কর্মক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। এই প্রযুক্তিগুলির উৎপাদনশীলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা থাকলেও এটি বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত মানুষদের চাকরি হারানোর হুমকিও তৈরি করেছে। 

নিকট-ভবিষ্যতে-যে-সকল-চাকুরিকে-কৃত্তিম-বুদ্ধিমত্তা-খেয়ে-নিতে-পারে


কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সিস্টেমগুলো আস্তে আস্তে প্রায়ই বেশি গতিতে, নির্ভুল ভাবে, এবং কম খরচে এমন সব কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হচ্ছে  যেগুলো ঐতিহ্যগতভাবে মানুষের দ্বারা সম্পন্ন করা হত। এই আর্টিকেলে এমন  নয়টি পেশার কথা আলোচনা করা হয়েছে যা অটোমেশনের কারনে বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, এবং এই ঝুঁকির পেছনের কারনগুলোও বিশ্লেষন করা হয়েছে।

সুচিপত্রঃ নিকট ভবিষ্যতে যে সকল চাকুরিকে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা খেয়ে নিতে পারে 

ডাটা এন্ট্রি  

ডাটা এন্ট্রি বা তথ্য প্রবেশকারী কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কম্পিউটার সিস্টেমে তথ্য প্রবেশ করানোর মাধ্যমে তথ্য পরিচালনা এবং তথ্যকে সঠিকভাবে সাজিয়ে নেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন।  ডাটা এন্ট্রির সাথে জড়িত লোকেরা ব্যাবসায়িক, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, গবেষনা এবং সরকারি প্রজেক্টের জন্য সংগ্রহ করা তথ্যগুলো সঠিক, সহজলভ্য এবং সুসংগঠিত রাখতে সাহায্য করে। তবে উন্নত কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির আবির্ভাব এই ক্ষেত্রে মানুষের নিয়োগের প্রয়োজনীয়তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। 

অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশন (OCR) এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের মতো কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চালিত প্রযুক্তিগুলো তথ্য প্রক্রিয়াকরণে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই প্রোগ্রামগুলো হাতে লেখা ডকুমেন্ট, ছবি এবং ডিজিটাল ফাইলের মতো বিভিন্ন উৎস থেকে দ্রুত তথ্য বের করতে, সংগঠিত করতে এবং বিশ্লেষণ করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই এসব প্রোগ্রামদের গতি ও দক্ষতা বেশিরভাগ সময়ে মানব কর্মীদের থেকে বেশি হওয়ায় তা তথ্য পরিচালনায় একটি নতুন মান স্থাপন করেছে। 

তথ্য নিয়ে কাজ করা সিস্টেমগুলোতে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ডেটা এন্ট্রির জন্য মানব কর্মীদের উপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবীর বড় বড় ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এমন কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেমকে পছন্দ করছে যা ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করতে পারে এবং ধারাবাহিকভাবে কাজের নির্ভুলতা বজায় রাখতে পারে। এসব পরিবর্তনের কারনে ডাটা এন্ট্রি পেশার চাহিদা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। 

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির সাথে সাথে তাই ম্যানুয়াল ডাটা এন্ট্রির ভবিষ্যত ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। যদিও কিছু বিশেষ কাজে এখনও মানুষের তত্ত্বাবধানের প্রয়োজোন হতে পারে, কিন্তু তারপরেও ডাটা এন্ট্রির নিয়মিত কাজগুলো কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে নিখুঁতভাবে করা সম্ভব। কাজের দক্ষতা বাড়ানো এবং খরচ কমানোর জন্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চালিত তথ্য প্রক্রিয়াকরন এখন ব্যবসার জন্য পছন্দের সমধানে পরিণত হচ্ছে।  


রিটেইল ক্যাশিয়ার 

রিটেইল ক্যাশিয়াররা সুপারশপ বা শপিংমলে লেনদেন সম্পন্ন করা, গ্রাহকদের সাহায্য করা এবং ক্যাশ রেজিস্টার পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। গ্রাহকরা প্রায়ই এসব দোকানে গিয়ে রিটেইল ক্যাশিয়ারদের সাথে যোগাযোগ করে থাকেন, যেখানে তারা গ্রাহকদের  সহজে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজে নিতে সাহায্য করে থাকেন। তবে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিগুলো এই ঐতিহ্যবাহী পেশার রূপ বদল করতে শুরু করেছে। 

সেলফ সার্ভিস চেকআউট সিস্টেম উন্নত বিশ্বে ক্রেতাদের কেনাকাটার ধরনে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। সেখানে এই মেশিনগুলো এখন মুদি দোকান, ফাস্ট-ফুড চেইন এবং অন্যান্য রিটেইল পরিবেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে ক্রেতারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের কেনাকাটা সম্পন্ন করতে পারেন। এই সিস্টেম মানব ক্যাশিয়ারদের উপর ক্রেতাদের নির্ভরতা কমিয়ে দিয়ে তাদের কেনাকাটা সম্পন্ন বা চেকআউট প্রক্রিয়া দ্রুততর করে। 

সেলফ সার্ভিস সিস্টেমের পাশাপাশি কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চালিত পেমেন্ট প্রযুক্তিগুলো রিটেইল খাতে আরও পরিবর্তন নিয়ে আসছে। উদাহরন স্বরূপ, অ্যামাজন কোম্পানির ক্যাশিয়ারবিহীন "জাস্ট ওয়াক আউট"
প্রযুক্তির মত উদ্ভাবন ক্রেতাদেরকে ক্যাশিয়ারদের কাছে টাকা পরিশোধ বা চেকআউট এড়িয়ে কেনাকাটা সম্পন্ন করার সুযোগ করে দেয়। গ্রাহকরা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে দোকান ছেড়ে চলে গেলে ক্যামেরা সেন্সর এবং কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এই সিস্টেমগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রাহকদের কেনা আইটেমগুলোর জন্য তাদের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা কেটে নেয়। 

এসব প্রযুক্তি গ্রহন করার ফলে ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কিছু লাভজনক সুবিধা পেয়ে আসছে। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চালিত স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমগুলোর কারনে ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন বোনাসের পেছনে বেশি খরচ করতে হয় না, একইসাথে কম কর্মচারী দিয়ে আরও বেশি লেনদেন পরিচালনা করা যায়। এর ফলে ক্রেতারাও দ্রুত এবং আরও সুবিধাজনকভাবে তাদের কেনাকাটা করতে পারে, যা আজকের ব্যাস্ত বিশ্বে ক্রমশ মূল্যবান হয়ে উঠেছে। 


টেলিমার্কেটিং   

টেলিমার্কেটাররা ঐতিহ্যগতভাবে ফোন কলের মাধ্যমে পণ্য ও সেবার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। তারা প্রায়ই সম্ভাব্য গ্রাহকদের সাথে বড় পরিসরে সংযোগ তৈরি করে বিক্রয় বা লিড তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করে থাকেন। তবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশনের অগ্রগতি এই পেশাকে খেয়ে ফেলার ভালো ঝুঁকি তৈরি করেছে। 

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং চ্যাটবট গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ পরিচালনায় অত্যন্ত দক্ষ হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরন বা Natural Language Processing (NLP) দিয়ে সাজানো এই প্রযুক্তিগুলো গ্রাহকদের নির্দিষ্ট চাহিদার সাথে মানিয়ে নিয়ে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাক্তিগত স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে পারে। শুধু তাই নয়, এসব সিস্টেম দক্ষতার সাথে গ্রাহকদের আপত্তি মোকাবেলা করা এবং তাদের জিজ্ঞাসার বিপরীতে বিস্তারিত ও সঠিক উত্তরও প্রদান করতে সক্ষম। 

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চালিত টেলিমার্কেটিং সিস্টেমের অন্যতম প্রধান সুবিধা হলো এর ক্লান্তিহীনভাবে বিশাল কাজ পরিচালনা করার ক্ষমতা। মানব টেলিমার্কেটারদের বিপরীতে, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা মান বজায় রেখে হাজার হাজার কল একসঙ্গে পরিচালনা করতে পারে। এছাড়াও এই সিস্টেমগুলো ২৪/৭ কাজ করতে পারে;  বিভিন্ন মানবিক ভুলের কারনে সিস্টেমকে কোনরকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় না।  

ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দিনে দিনে যতই নিজেদের মধ্যে দক্ষতা বাড়ানোর উপায় খুঁজছে, স্বয়ংক্রিয় টেলিমার্কেটিং সিস্টেমগুলো ততই তাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।  এই সিস্টেমগুলো শ্রম খরচ কমানোর পাশাপাশি ধারাবাহিক ও নির্ভরযোগ্য পারফরম্যান্স প্রদান করে। এর ফলে কোম্পানিগুলি কম সময়ে আরও বেশি গ্রাহকদের কাছে তাদের পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপন পৌছে দিতে সক্ষম হয়, যা তাদের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা  বাড়ায়।  

গুদাম এবং কারখানায় কাজ করা কর্মীরা 

গুদাম এবং উৎপাদন কারখানায় রোবোটিক্স এবং কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সংযোজন পণ্য উৎপাদন, সংরক্ষন এবং বিতরনের পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। এই প্রযুক্তিগুলো ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় কাজ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে এবং ভুল করার প্রবণতা কমিয়ে এনে একই ধরনের কাজগুলোকে মানব কর্মী ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে দেয়। এর ফলে পণ্য সরবরাহ ব্যাবস্থা (Supply Chain) আরও দ্রুত, নির্ভরযোগ্য এবং অত্যন্ত কার্যকরি হয়ে উঠছে। 

রোবট এখন পণ্য সাজানো, প্যাকিং, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জোড়া লাগানো (assembly), এবং বিতরন করার মতো বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করতে পারে। তারা অসাধারন গতি এবং নির্ভুলতার সাথে কাজ করে, জটিল ও শারিরিকভাবে চ্যালেঞ্জিং কাজ করার ব্যাপারে মানব কর্মীদের সক্ষমতাকেও অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। এরকম অটোমেশন প্রযুক্তি ধারাবাহিকভাবে পণ্যের গুনগত মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যাবসার পরিচলন ব্যয় কমায়। 

অ্যামাজন এবং টেসলার মত প্রথমসারীর বৈশ্বিক কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবোটিক্স ব্যবহার করে তাদের প্রচলিত উৎপাদন ব্যাবস্থাকে রুপান্তর করছে। এই প্রযুক্তিগুলো তাদেরকে মানব শ্রমের উপর নির্ভরতা কমিয়ে দিয়ে কারখানার উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে । উৎপাদন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোকে রোবোটের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালানোর মাধ্যমে এই কোম্পানিগুলো আজকের বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল বাজারে প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকতে পারে। 

অটোমেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাগুলির মধ্যে একটি হল এটি বিরতি বা শিফট ছাড়াই দিন রাত সারাক্ষণ কাজ চালিয়ে যেতে পারে। এটি এমন একটি সাশ্রয়ী সমাধান যা ব্যাবসাগুলিকে ক্রমবর্ধমানভাবে স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠা বিশ্বে প্রতিযোগীতামূলক করে রাখতে সাহায্য করে। রোবোটিক্স এবং কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা আরও উন্নত হওয়ার সাথে সাথে সরবরাহ শৃঙ্খলায় (Supply Chain) এর প্রভাব আরও বাড়বে বলে ধারনা করা যায়।  

নিকট-ভবিষ্যতে-যে-সকল-চাকুরিকে-কৃত্তিম-বুদ্ধিমত্তা-খেয়ে-নিতে-পারে



অ্যাকাউন্টিং এবং বুককিপিং

অ্যাকাউন্টিং পেশায় নিয়জিত ব্যাক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে সঠিকভাবে আর্থিক তথ্য ব্যাবস্থাপনায় তাদের বিশেষ দক্ষতার জন্য পরিচিত। অ্যাকাউন্টেন্ট এবং বুককিপাররা সাধারনত লেনদেন রেকর্ড করা, আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা এবং আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জটিল আর্থিক তথ্য বিশ্লেষণে তাদের দক্ষতা তাদেরকে ছোট-বড় সব ধরনের ব্যাবসার জন্য অপরিহার্য করে তুলেছে। 

তবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি অ্যাকাউন্টিং পেশায় মানুষের প্রয়োজনীয়তাকে ধীরে ধীরে ছোট করে ফেলছে। কুইকবুকস (QuickBooks), জিরো (Xero)  এবং অন্যান্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চালিত অ্যাকাউন্টিং
সফটওয়্যার অনেক কাজকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে দেবার ক্ষমতা রাখে, যেগুলো আগে মানুষের সাহায্যে করা হত। এই সিস্টেমগুলো মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে বুককিপিং সহজতর করে, সঠিক আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে এবং আর্থিক তথ্যে অসঙ্গতি শনাক্ত করতে পারে। 

এসব কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চালিত সফটওয়্যারগুলোর একটি প্রধান সুবিধা হলো যে এরা বিশাল ডেটা দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রক্রিয়াজাত করার ক্ষমতা রাখে। এরা আর্থিক লেনদেনের তথ্যে এমন প্যাটার্ন, প্রবণতা এবং অনিয়ম চিহ্নিত করতে পারে যেগুলো সম্পন্ন করতে মানব অ্যাকাউন্টটেন্টদের অনেক বেশি সময় লাগত। এর ফলে, আর্থিক ব্যাবস্থাপনার সাথে জড়িত ফার্মগুলো তাদের কাজের গতি বাড়ানো এবং তথ্যের নির্ভুল হওয়া নিশ্চিত করতে ক্রমেই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়িয়ে দিচ্ছে।  

কর্মক্ষেত্রে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ অ্যাকাউন্টন্ট এবং বুককিপারদের ঐতিহ্যবাহী ভূমিকায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। রুটিন এবং ম্যানুয়েল কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় হবার ফলে এই পেশার লোকেরা এখন আর্থিক পরিকল্পনা, ডেটা বিশ্লেষন এবং ব্যাবসায়িক সিদ্ধান্তে পরামর্শ দেবার মতো কৌশলগত কাজে মনোযোগ দিচ্ছে। অ্যাকাউন্ট পেশার এই বিবর্তন পেশাজীবী অ্যাকাউন্টেন্টদের কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে উৎপন্ন করা তথ্য বিশ্লেষন করা এবং প্রযুক্তি ব্যাবহার করে তাদের পেশাকে আরও কার্যকর করার মতো নতুন দক্ষতা আর্জন করার প্রয়োজনীতা তৈরি করেছে। 


সাংবাদিকতা এবং কন্টেন্ট নির্মান

সৃষ্টিশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং গল্প বলার দক্ষতার উপর নির্ভর করার জন্য সাংবাদিকতা এবং কন্টেন্ট তৈরি করাকে ঐতিহ্যগতভাবে একান্তই মানব কেন্দ্রিক কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আবহমান কাল থেকে লেখক এবং সাংবাদিকরা আকর্ষনীয় কাহিনী তৈরি করে এবং জটিল বিষয়গুলো বিশ্লেষন করে পাঠকদের তথ্য প্রদান, বিনোদন এবং অনুপ্রানিত করার কাজ করে আসছেন।মানুষের সৃষ্টিশীলতা ভিত্তিক এই পদ্ধতিটি যুগের পর যুগ ধরে এই শিল্পের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। 

কিন্তু, বর্তমানে চ্যাটজিপিটি এবং জ্যাসপারের মতো কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চালিত রাইটিং টুলস্‌গুলো কন্টেন্ট নির্মানের প্রচলিত ধারনাগুলোকেই যেন বদলে দিচ্ছে। এই সিস্টেমগুলো ব্যবহারকারীদের চাহিদা অনুসারে আর্টিকেল, ব্লগ পোস্ট এবং মার্কেটিং কপির মতো কন্টেন্ট তৈরি করতে পারে। উন্নত অ্যালগরিদম ব্যবহার করে তারা এত দ্রুত মানসম্পন্ন কন্টেন্ট তৈরি করতে পারে যার ফলে কন্টেন্ট এর জন্য মানব লেখকদের প্রয়োজনীয়তাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। 

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক টুলস্‌গুলোর ফর্মুলাভিত্তিক বা ডেটা নির্ভর কন্টেন্ট সহজেই পরিচালনা করার দক্ষতা তাদের বড় শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা, খেলার সারাংশ এবং পণ্যের বিবরন লেখার মত কাজগুলো তারা মানুষের তুলনায় অনেক কম সময়ে করে দিতে পারে। এই জন্যে প্রকাশনা ব্যাবসার সাথে জড়িত কোম্পানিগুলো কন্টেন্টকে তাদের চাহিদামতো উৎপন্ন করা এবং ব্যাবসার খরচ কমানোর জন্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাকে মানব লেখকদের বিপরীতে একটি আকর্ষণীয় বিকল্পে পরিনত করছে। 

সাংবাদিকতা এবং কন্টেন্ট নির্মানে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ এই শিল্পগুলোতে মানব কর্মীদের ভবিষ্যত প্রয়োজনীয়তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। যদিও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন টুলস্‌গুলো প্রকাশকদের দক্ষতা এবং স্কেল বাড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে, তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগুলো মানব লেখকদের চাকুরি খেয়ে নেবার ঝুঁকিও তৈরি করছে। প্রুযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে কন্টেন্ট নির্মাতাদের সৃষ্টিশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং মানুষের আবেগ স্পর্শ করতে পারে এমন কন্টেন্ট তৈরি করার মত গুনগুলো অর্জন করতে হবে। 


ট্যাক্সি এবং ট্রাক চালকদের চাকুরি

পরিবহন শিল্প কৃত্তিম বুদ্ধিমতা নির্ভর স্বচালিত যানবাহনের উদ্ভাবনের ফলে একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। জটিল রাস্তা পদ্ধতিতে নিজেদের পথ খুঁজে নিতে পারে এমন চালকবিহীন গাড়ি ও ট্রাক তৈরি করে ওয়েমো, টেসলা এবং উবারের মত কোম্পানিগুলো এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এসব উদ্ভাবনের ফলে অটোমেশন মানুষ এবং পণ্যের চলাচলে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। 

চালকবিহীন যানবাহন উন্নত AI সিস্টেমের উপর নির্ভর করে সেন্সর, ক্যামেরা এবং জিপিএস প্রযুক্তি থেকে তাদের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াজাত করতে শুরু করে। এসব তথ্যের উপর ভিত্তি করে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ট্রাফিকের ধরন, রাস্তার অবস্থা এবং সম্ভাব্য বিপদ যাচাই বাছাই করে গাড়ী চলাকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর ফলে রাস্তার পথচারীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি, মানব ত্রুটি হ্রাস এবং পরিবহন ব্যাবস্থার সামগ্রিক উন্নতি সাধন হতে পারে। 

উন্নত বিশ্বে ট্রাকিং ব্যাবসায় চালকবিহীন পরিবহন ব্যাবস্থা সেই ইন্ড্রাস্ট্রির বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য একটি ভালো সমাধান নিয়ে এসেছে। ড্রাইভারের ঘাটতি, দুর-পাল্লার পরিবহন চাহিদা এবং পরিচালন ব্যয় কমানোর প্রয়োজন কোম্পানিগুলোকে চালকবিহীন ট্রাকের প্রতি আগ্রহ বাড়াচ্ছে। এরকম স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত যানবাহনগুলো বিশ্রামের প্রয়োজন ছাড়াই দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে পারার কারনে সেগুলো পণ্য আনা নেওয়া করে এমন কোম্পানিগুলোর কাছে ক্রমেই মূল্যবান হয় উঠছে।

নিকট ভবিষ্যতে যখন স্বচালিত যানবাহনগুলো আরও নির্ভরযোগ্য এবং ব্যাপকভাবে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠবে, তখন বানিজ্যিক ড্রাইভিংয়ের উপর এর প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই প্রযুক্তি আরও দক্ষ এবং ব্যয় সাশ্রয়ী হয়ে ওঠার সাথে সাথে মানব ড্রাইভারদের চাহিদা কমে গিয়ে তাদের চাকুরি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।  এই খাত নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা তাই মানব ড্রাইভারদের পুনপ্রশিক্ষন এবং কর্মশক্তি অভিযোজন নিয়ে নীতি নির্ধারকদের মাঝে আলোচনা প্রয়োজন বলে মনে করে থাকেন।  

নিকট-ভবিষ্যতে-যে-সকল-চাকুরিকে-কৃত্তিম-বুদ্ধিমত্তা-খেয়ে-নিতে-পারে



লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং প্যারালিগাল কাজ

লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং প্যারালিগালরা ঐতিহ্যগতভাবে নথি পর্যালোচনা, আইনি গবেষনা এবং চুক্তি প্রস্তুতির কাজ পরিচালনা করার মাধ্যমে আইনি পেশায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে আসছেন। এসব বিষয়ে তাদের দক্ষতার ফলে আইনজীবীরা মামলা পরিচালনা করার জন্য ভালোভাবে প্রুস্তুত হতে পারে এবং সঠিক আইনি পরামর্শ দিতে সক্ষম হয়। মানব কেন্দ্রিক এই পদ্ধতি দীর্ঘদিন ধরে আইনি কাজের মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে।

তবে ROSS ইন্টেলিজেন্স এবং Casetext এর মতো কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক টুলস্‌গুলোর আবির্ভাব প্যারালিগাল এবং লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টদের ভূমিকায় মানুষের প্রয়োজনীয়তা কতখানি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই AI সিস্টেমগুলো দ্রুত বিশাল  আইনি ডেটাবেস বিশ্লেষন করে প্রাসঙ্গিক কেস ল, আইন এবং নজির চিহ্নিত করতে পারে। গবেষনার প্রক্রিয়া সহজ করার মাধ্যমে, AI আইন ফার্মগুলোকে সময় এবং সম্পদের উল্লেখযোগ্য সাশ্রয় করার সুযোগ করে দিচ্ছে।

আইন গবেষনা ছাড়াও, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা আইনি নথি প্রস্তুত করা এবং ডিউ ডিলিজেন্স পরিচালনার মতো কাজগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে পারে। এই সিস্টেমগুলো অসাধারন নির্ভুলতার সাথে চুক্তি তৈরি করতে, জটিল আইনি তথ্য বিশ্লেষণ করতে এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করতে পারে। ম্যানুয়াল কাজের চাপ কমিয়ে এবং একই সাথে ভুলের সম্ভাবনা হ্রাস করে প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য অনেকে আইনি প্রতিষ্ঠানের কাছেই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এখন একটি আকর্ষনীয় সমাধান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।  

আইনি কাজে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমবর্ধমান ব্যবহার প্যারালিগালদের ঐতিহ্যবাহী ভূমিকার ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। রুটিন কাজগুলো আস্তে আস্তে স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাওয়ায়, এই ক্ষেত্রে মানব কর্মীদের চাহিদা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং প্যারালিগালদের কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যায় না এমন বিশেষায়িত ও কৌশলগত কাজে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। 

বড় পরিসরে কর্মক্ষেত্রে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব

ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প এবং গবেষনায় কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশনের ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ কাজের ভবিষ্যতকে নতুনভাবে গড়ে তুলছে, যার ফলে নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবার পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাকুরি চলে যাবার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এই প্রযুক্তিগুলো ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং শিল্পক্ষেত্রে উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করার প্রুতিশ্রুতি দিচ্ছে। তবে এগুলো বিশেষ করে একই ধরনের কাজ করা হয় এমন সেক্টরগুলোতে চাকরি হারানোর উদ্বেগও তৈরি করেছে। 

রুটিন কাজের উপর নির্ভরশীল শিল্পগুলোতে অটোমেশনের প্রয়োগ এসব জায়গায় ভালো পরিমান চাকুরি খেয়ে ফেলতে পারে। এই খাতে কাজ করা লোকেরা পরিবর্তিত শ্রমবাজারে নতুন ভূমিকা গ্রহনে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারেন।  উদীয়মান চাকুরির সুযোগগুলোর জন্য তাদেরকে প্রস্তুত করতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এসব খাতে নিয়োজিত কর্মীদের পুনঃপ্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রোগ্রামের আওতায় নিয়ে আসা উচিৎ। 

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সিস্টেমগুলোর প্রয়োগের নেতিবাচক ফলাফলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। নিম্ন দক্ষতার কাজগুলো যন্ত্র দিয়ে প্রতিস্থাপিত হওয়ায়, শিক্ষার বা প্রশিক্ষনের সুযোগের অভাবে কর্মীদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে আয়ের বৈষম্য আরও বাড়তে পারে এবং সমাজে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে। 

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর বিশ্বে টিকে থাকার জন্য আজীবন শেখার এবং পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেবার ওপর জোড় দিতে হবে। সরকার, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান এবং ধনী ব্যাক্তিদের শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান পরিবর্তনের জন্য সহযোগীতা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারলে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধাগুলো কাজে লাগানো সম্ভব, পাশাপাশি এর সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকগুলোও কমিয়ে আনা যাবে। 

শেষ কথা 

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশন অভূতপূর্ব গতিতে চাকরির বাজারকে পরিবর্তন করে চলেছে। এর ফলে কিছু পেশা ঝুঁকিতে থাকলেও, এই প্রযুক্তিগুলোর উত্থান উদ্ভাবন এবং প্রবৃদ্ধির জন্য সুযোগ করে দিয়েছে।

অটোমেশনের ফলে যে চাকুরিগুলো সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে তা বোঝা এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেবার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেবার ক্ষমতাকে উৎসাহিত করে এবং পরিবর্তনকে গ্রহন করে, সমাজ ও রাষ্ট্র কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধাগুলকে কাজে লাগাতে পারে এবং এর নেতিবাচক দিকগুলো কমিয়ে আনতে পারে।  

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url