সোশ্যাল মিডিয়াগুলো যেভাবে আমাদের ক্ষতি করছে

  

ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার (X), এবং টিকটকের সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো ইন্টারনেট ব্যাবহারকারীদের নিজেদের মাঝে সংযোগ স্থাপন, যোগাযোগ এবং তথ্য শেয়ার করার পদ্ধতিতে বৈপল্বিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তবে, এগুলোর কিছু উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক দিকও রয়েছে। 

সোশ্যাল-মিডিয়াগুলো-যেভাবে-আমাদের-ক্ষতি-করছে


সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে এটি প্রমানিত হয়েছে যে সোশ্যাল মিডিয়াগুলো, এর বর্তমান রূপে, ব্যাক্তি ও সমাজ উভয়ের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এই আর্টিকেলে সোশ্যাল মিডিয়াগুলো আমাদেরকে মানসিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক ভাবে যে নয়টি প্রধান ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে তা বিশ্লেষন করা হলো। 

সুচিপত্রঃ সোশ্যাল মিডিয়াগুলো যেভাবে আমাদের ক্ষতি করছে

মানসিক সমস্যাগুলো 

সোশ্যাল মিডিয়াগুলো আধুনিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এদের প্রভাব বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরনস্বরূপ, ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের মত প্ল্যাটফর্মগুলো প্রায়ই ব্যাবহারকারীদের জীবনের কেবলমাত্র সুখী ও উজ্জ্বল মুহূর্তগুলো তুলে ধরে একটি অসম্পুর্ন এবং বিকৃত বাস্তবতা তৈরি করে। অন্যান্য ব্যাবহারকারীরা যখন এর সাথে নিজের জীবনের তুলনা করতে শুরু করে তখন তারা একধরনের মানসিক চাপ অনুভব করে; অভাব ও অসন্তোষের কারনে তৈরি হওয়া এরকম মানসিক চাপ ব্যাবহারকারীদের উদ্বেগ, বিষন্নতা, এবং আত্মসম্মানের ঘাটতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। 

সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর একটি প্রধান সমস্যা হলো এটি নিখুঁত থাকার সংস্কৃতি তৈরি ও প্রচার করে।ইনফ্লুয়েন্সাররা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকম এডিট করা ও ফিল্টার দেওয়া ছবি পোস্ট করা এবং যত্নসহকারে এডিট করা ভিডিও শেয়ার করে তরুন প্রজন্মের মনে চেহারা ও সাফল্য নিয়ে অবাস্তব ধারনা তৈরি করে। এর ফলে তাদের নিজেদের শরীর নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং ক্ষতিকর আচরন যেমন না থেয়ে থাকার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। 

সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর আসক্তি সৃষ্টি করা ডিজাইন এদের নেতিবাচক প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে দেয়। অন্তহীন ভাবে স্ক্রল করতে পারার ক্ষমতা এবং সারাক্ষণ নোটিফিকেশন পাওয়ার মত ফিচারগুলো তৈরিই করা হয়েছে যাতে ব্যাবহারকারীরা লম্বা সময় ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবস্থান করে। এর ফলে স্বাভাবিক ঘুমের ধারা ব্যাহত হয়, উৎপাদনশীলতা কমে যায়, এবং চাপ বেড়ে যায়। 

এছাড়াও, বাদ পড়ে যাবার ভয় (the fear of missing out বা FOMO) এক ধরনের মানসিক জটিলতা যা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আরও জটিল রূপ ধারন করে। অন্যদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ইভেন্ট বা কর্মকান্ডে অংশ নিতে দেখে অনেকের মধ্যে বঞ্চিত হওয়া বা বৈষ্যম্যের শিকার হওয়ার অনুভূতি তৈরি হয়। এই অনুভূতিগুলো তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতীবাচক প্রভাব ফেলার পাশাপাশি তাদের নিজেদের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার মনোভাবও নষ্ট করে দেয়। 


সময়ের অপচয় 

সোশ্যাল মিডিয়াগুলোকে উদ্দেশ্যমুলকভাবে আসক্তিকর করে সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে ব্যাবহারকারীরা দীর্ঘ সময় ধরে তাদের ওয়েবসাইটগুলোতে সময় কাটায়। অন্তহীনভাবে স্ক্রলিং করতে পারা, সাইটগুলোতে আপনাআপনি ভিডিও চালু হওয়া, এবং ব্যাবহারকারীদের পছন্দ অপছন্দ ধরতে পারার মত অ্যালগরিদম ব্যাবহারকারীদের সারাক্ষন সোশ্যাল মিডিয়া গুলোতে আকর্ষন ধরে রাখতে সাহায্য করে। এই ফিচারগুলো মানুষের মস্তিস্কের ডোপামিন (এক ধরনের হরমোন যা মনে আনন্দের ভাব জাগায়) সিস্টেমকে অপব্যাবহার করে; যার ফলে ব্যাবহারকারীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বারবার ফিরে আসার একটি প্রবনতা তৈরি হয়। 

সোশ্যাল মিডিয়ার এই আসক্তিকর উপাদানগুলো সময়ের বড় অপচয়ের কারন হয়ে দাঁড়ায়। একজন ব্যাক্তি তার জীবনের যে সময়গুলোতে নতুন কিছু শিখতে পারত বা নতুন কোন দক্ষতা অর্জন করতে পারত; যে সময়গুলো সে শারীরিক পরিশ্রম বা প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটানোর মত কার্যকর কাজে ব্যাবহার করতে পারত সেই সময়গুলো সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অযথা স্ক্রলিং করে নষ্ট করে। সময়ের এই অপব্যাবহার প্রায়ই ব্যাবহারকারীদের অনুতপ্ত করে তাদের ব্যাক্তিগত জীবনে অসম্পুর্নতার ভাব এনে দেয়। 

অনেকের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার উপর আসক্তি তাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন জরুরী কাজগুলো করতে বাধা দেয়। ব্যাবহারকারীরা তাদের দ্বায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো ভুলে গিয়ে ডিজিটাল ডিভাইসে বেশি সময় ব্যয় করার ফলে তাদের দৈনন্দিন রুটিন অবহেলিত হয়ে যায়। এর ফলে ব্যাবহারকারীদের কাজ করার ক্ষমতা অথবা পড়াশুনা করার আগ্রহও কমে যায়, যা মানসিক চাপ এবং অসন্তোষকে আরও বাড়িয়ে তোলে। 

অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাবহার করার কারনে ব্যাক্তিগত সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বাস্তব জীবনে সামনাসামনি একে অপরের সাথে কথা বলার পরিবর্তে অনেকেই ভার্চুয়াল সংযোগের প্রতি বেশি মনযোগ দেয়, যা তাদের মনে একাকিত্বের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। সময়ের সাথে সাথে, এই অতিরিক্ত অনলাইন নির্ভরতা প্রিয়জনদের সংগে ব্যাবহারকারীর আবেগগত সম্পর্ক দুর্বল করে  দেয়।


মিথ্যা তথ্যের প্রচার 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আজকাল ভুল তথ্য এবং মিথ্যা খবরের প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সমাজের জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলো ব্যাবহারকারীরা যে কন্টেন্ট শেয়ার করে তার সত্যতা নিশ্চিত করার চাইতে ব্যাবহারকারীরা সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে কতখানি সক্রিয় তার উপর গুরুত্ব দেবার কারনে সংবেদনশীল বা বিভ্রান্তি তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে মিথ্যা তথ্যগুলো কোন রকমের বাধা ছাড়াই ছড়িয়ে পড়তে থাকলে তা সমাজে একটি রিপল ইফেক্ট (Ripple Effect) তৈরি করবে যার ফলে কোন চলমান এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিয়ে সমাজের লোকেদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা যাবে এবং তাদেরকে বিপথে পরিচালিত করা যাবে। 

রাজনৈতিক সংকট, স্থানীয় এবং জাতীয় নির্বাচন, অথবা মহামারী জনিত জরুরী অবস্থার সময়ে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ছড়িয়ে পড়া গুজবগুলো বিশেষ ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়। এই সময়ে ভুল তথ্য জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে তাদের মাথা খারাপ করে দিতে পারে। জরুরী অবস্থার সময় ভিত্তিহীন গুজব প্রায়ই বিশ্বস্ত সুত্র থেকে পাওয়া সঠিক ও জীবনরক্ষাকারী পরামর্শকে আড়াল করে ফেলে। 

উদাহরনস্বরূপ, কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার বিপদ সম্পর্কে একটি ভালো ধারনা পাওয়া গেছে। মহামারী চলাকালীন সময়ে চিকিৎসা ও টিকার বিষয়ে ভ্রান্ত ধারনাগুলো অনেক লোককে ভ্যাক্সিন নেওয়া থেকে বিরত রেখেছিল, যার ফলে করোনা ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রন করা অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ভুল তথ্যের প্রসারের কারনে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমে যায় এবং তারা বৈজ্ঞানিক পরামর্শ নিতে অনীহা বোধ করে।  

এর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আজকাল বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো মানুষের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিভাজন ঘটিয়ে গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের বিশ্বাস দুর্বল করে দেয়। এর ফলে সামাজিক সংহতি নষ্ট হয়ে যায় এবং বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ে। 

সোশ্যাল-মিডিয়াগুলো-যেভাবে-আমাদের-ক্ষতি-করছে



সাইবার বুলিং এবং অনলাইন হয়রানি 

সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলোতে সাইবার বুলিং একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে, যেখানে অসৎ প্রকৃতির লোকেরা বেনামে এবং দুরত্বের সুযোগ নিয়ে ইন্টারনেট ব্যাবহারকারীদের সাথে হয়রানি এবং খারাপ আচরন করে থাকে। এই প্লাটফর্মগুলোর ডিজিটাল প্রকৃতি এসব ক্ষতিকর বার্তাগুলোকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে, যার ফলে ভিক্টিমদের এটি আরও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। সব বয়সের ব্যাবহারকারীরা সাইবার বুলিং এর শিকার হয়ে থাকলেও, এটি তরুন প্রজন্মের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। 

সাইবার বুলিংয়ের শিকার ব্যাক্তিরা প্রায়ই গভীর মানসিক যন্ত্রনায় (যেমন উদ্বেগ, বিষন্নতা, এবং একাকীত্ব) ভুগে থাকেন। গুরুতর ক্ষেত্রে, এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে ভিক্টীমরা নিজেদের শারীরিক ক্ষতি বা আত্মহত্যার চিন্তা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যাও করে থাকে। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ভিক্টিমরা দীর্ঘমেয়াদে নানা রকম মানসিক রোগে ভোগে, তাদের লেখাপড়ার মান খারাপ হতে থাকে, এবং তাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোও ক্ষয়ে যেতে থাকে। 

অনলাইন হয়রানি কেবল ব্যাক্তিবিশেষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি অনেক সময় জাতিগত ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গ্রুপগুলোকেও টার্গেট করে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক বিপথগামী লোকেরা একসাথে মিলে গ্রুপগুলো সম্পর্কে ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় করার চেষ্টা করে। এই ধরনের আচরন প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য বাড়ায় এবং সমাজে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীদের প্রান্তিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে।  

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি হয়রানির বিরুদ্ধে নানা রকম নীতি এবং কৌশল প্রয়োগ করলেও তারা প্রায়ই সাইবার বুলিং প্রতিরোধে কার্যকর হতে ব্যার্থ হয়। সামাজিক মাধ্যমগুলোর মডারেশন ব্যাবস্থ্যায় প্রায়ই নানা রকম অসংগতি এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক মডারেটর না থাকার ফলে ক্ষতিকারক বিষয়বস্তু অনলাইনে থেকে যায়। এই জবাবদিহিতার অভাব সোশ্যাল মিডিয়ায় সাইবার বুলিং এবং অনলাইন হয়রানির মত বিষাক্ত আচরণকে চলমান এবং আরও তীব্র হওয়ার সুযোগ করে দেয়। 


গোপনীয়তা নষ্ট হওয়া 

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি প্রায়ই ব্যাবহারকারীদের স্পষ্ট সম্মতি ছাড়াই তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান ব্যাক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে। এই তথ্যগুলো ব্যাবহার করে তারা সামাজিক মাধ্যম ব্যাবহার কারীদের বিশদ আচরণগত প্রোফাইল তৈরি করে; এর মাধ্যমে তারা ব্যাবহারকারীদের টার্গেটেড বিজ্ঞাপন দেখিয়ে টাকা ইনকাম করে। এভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যাবহারকারীদের কাছ থেকে ব্যাক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা তাদের গোপনীয়তা এবং সম্মতির বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করে। 

ক্যামব্রিজ অ্যানালাইটিকা কেলেঙ্কারির মতো হাই প্রোফাইল ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর তথ্য সংগ্রহের ঝুঁকিগুলো আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তোলে। এই ধরনের ঘটনার মাধ্যমে ব্যাবহারকারীদের সংবেদনশীল তথ্য ফাঁস হয়ে যাবার ফলে তারা বড় পরিসরে অপব্যাবহার এবং প্রতারনার শিকার হয়। এমন ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করে দেয়। 

তথ্য ফাঁস ছাড়াও ব্যাবহারকারীরা প্রায়ই তাদের অজান্তেই তাদের ভৌগলিক অবস্থান, দৈনন্দিন রুটিন, এবং ব্যাক্তিগত পছন্দ অপছন্দের মতো সংবেদনশীল তথ্য শেয়ার করে থাকে। এই তথ্যগুলো হ্যাকার, অনাকাঙ্ক্ষিত অনুসরণকারী (Stalker), বা অনলাইন পরিচয় চোরদের দ্বারা অপব্যাবহৃত হতে পারে, যার ফলে তারা বড় নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে। এমন তথ্য সহজেই অসৎ প্রকৃতির লোকেদের হাতে আসার ব্যাপারটা ডিজিটাল জগতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাবহারকারীদের দুর্বলতাকে তুলে ধরে।

সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলি ব্যাবহারকারীদের ডাটা কিভাবে ম্যানেজ করে তা সম্পর্কে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাব গোপনীয়তার অভাবকে আরও প্রকট করে তোলে। অনেক সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম তাদের তথ্য সংগ্রহ ও তথ্য শেয়ারিংয়ের গুরুত্বপূর্ন বিবরণগুলো দীর্ঘ শর্তযুক্ত পরিষেবা চুক্তিতে (Service Agreement) লুকিয়ে রাখে। এর ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাবহারকারীদের তথ্য কতটুকু এবং কিভাবে ব্যাবহার করা হচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের বেশিরভাগেরই কোন ধারনা থাকে না। 


বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোর উপর প্রভাব 

পরিহাসের বিষয় হলো, সোশ্যাল মিডিয়াগুলো সমাজের মানুষদের কাছাকাছি নিয়ে আসার কথা বললেও এরা প্রায়ই বাস্তব জীবনের সম্পর্কের ক্ষতি করে থাকে। ব্যাবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অতিরিক্ত সময় অপচয় করার কারনে তারা পরিবারের সদস্য এবং পরিচিতজনদের সাথে সামনাসামনি যোগাযোগের জন্য খুবই কম সময় পেয়ে থাকে। এতে পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে তাদের সম্পর্কের গভীরতা এবং মান কমে যায়। 

ইনস্টাগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাটের মত প্ল্যাটফর্ম বিবাহিত জীবনে স্বামী স্ত্রীদের মধ্যে হিংসা ও অবিশ্বাসের অনুভূতি তৈরি করতে পারে। তাদের এসব জায়গায় অন্যান্য ব্যবহারকারীদের সাথে কথাবার্তা এবং যোগাযোগ করা ভুলভাবে ধরে নেওয়া হতে পারে, যার ফলে সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই ধরনের সমস্যা সময়ের সাথে সাথে বিবাহিত জীবনে বিশ্বাস এবং আবেগগত ঘনিষ্ঠতায় ফাটল ধরায়। 

সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারীদের নিজেদেরকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করার প্রবণতা সঙ্গী অথবা বন্ধুদের মাঝে অস্বাস্থ্যকর তুলনা করার মনোভাব তৈরি করতে পারে। অন্যদের জীবনের চমৎকারভাবে এডিট করা "হাইলাইট রিলস্‌" দেখে ব্যবহারকারীদের মনে নিজেদের জীবন এবং সম্পর্ক নিয়ে অসন্তুষ্টির ভাব তৈরি হতে পারে। এই ধরনের অবিরাম তুলনা ব্যবহারকারীদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে এবং সম্পর্কের টানাপোড়ন বাড়ায়। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের নিজেদের পোস্টে লাইক, কমেন্ট এবং ফলোয়ার দিয়ে সামাজিক স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা তাদের বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোর আবেগগত ঘনিষ্ঠতাকে বাধাগ্রস্থ করে। তারা বাস্তব জীবনে মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপন করার চেয়ে অনলাইনে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করাকে বেশি গুরুত্ব দেয়, যার ফলে তাদের জীবন বাহিরে থেকে সুন্দর দেখালেও তা ভেতরে ভেতরে ফাঁকা হয়ে ওঠে। এতে তাদের জীবনকে তাদের নিজেদের কাছে অর্থহীন এবং অপূর্ন মনে হতে পারে। 

সৌন্দর্যের অবাস্তব ধারনাকে প্রতিষ্ঠা করা 

সোশ্যাল মিডিয়ায় সৌন্দর্য, সাফল্য এবং জীবনযাপনের অবাস্তব ধারনা প্রচারিত হয়, যা মানুষের ভালো থাকার জন্য বাধার সৃষ্টি করে। ইনফ্লুয়েন্সার এবং সেলিব্রিটেরা প্রায়ই দেশে বিদেশে বিলাসবহুল ভ্রমন করে, দামী ডিজাইনার পোশাক পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদেরকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করে থাকে।স্বাভাবিকভাবেই এসব জিনিস বাস্তবে জীবনে না পাওয়ার আক্ষেপ থেকে সাধারন মানুষের মনে নিজেদের অযোগ্যতা এবং ব্যার্থ্যতার অনুভূতি সৃষ্টি হয়।

এই সমস্যাটি বিশেষ করে তরুন ব্যবহারকারীদের জন্য আরও ক্ষতিকর হতে পারে, কারন তারা জীবনের এমন অবাস্তব আদর্শগুলোকে সহজেই তাদের জীবনে প্রয়োগ করতে চায়। তারা মনে করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইনফ্লুয়েন্সার মতো চলাফেরা, তাদের মত স্টাইল করতে পারলেই তারা তাদের বন্ধুবান্ধব ও সমবয়সীদের কাছে দাম পাবে। এর ফলে তারা প্রায়ই অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে, যা তাদের মানসিক ভাবে ভালো থাকা এবং আত্মমর্যাদায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

সৌন্দর্যের এই অবাস্তব ধারনাকে নিজেদের জীবনে বাস্তবে পরিনত করার ইচ্ছা প্রায়ই ব্যবহারকারীদের ক্ষতিকারক ও অস্বাভাবিক আচরনের দিকে নিয়ে যায়। উদাহরন স্বরূপ, তারা চিকন হবার জন্য অতিরিক্ত ডায়েট, বিলাসবহুল জিনিসপত্রে অতিরিক্ত ব্যয়, বা লাইক কামানোর জন্য ব্যক্তিগত মুল্যবোধের সাথে আপস করতে পারে। এই ধরনের কাজ ব্যাক্তিগত সম্পদের অপচয় করার পাশাপাশি ব্যাক্তির প্রকৃত এবং নির্ভেজালভাবে আত্মপ্রকাশ করার ক্ষমতাও নষ্ট করে দেয়। 

সোশ্যাল-মিডিয়াগুলো-যেভাবে-আমাদের-ক্ষতি-করছে



ইকো চেম্বার তৈরি হওয়া

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীদের আগ্রহ ও বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কন্টেন্ট দেখানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এভাবে ব্যক্তিগতকরনের কারনে ব্যবহারকারীরা সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক সময় ধরে থাকে, যার ফলে ব্যবহারকারীদের সাথে সাইটগুলোর  এনগেইজমেণ্ট বেড়ে যায়। তবে এটি ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন বৈচিত্রময় ধারনার  সাথে পরিচিত হবার সুযোগ কমিয়ে দিয়ে ইকো চেম্বার তৈরি করে এবং ব্যবহারকারীদের আগে থেকে ধারন করা মতামতগুলোকে আরও শক্তিশালী করে। 

ইকো চেম্বারে ব্যাক্তিরা বারবার একই ধরনের মতামতের মুখোমুখি হয়, যার ফলে তাদের বিশ্বাস আরও গভীর হয়। তাদের বিশ্বাস এবং ধ্যানধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে এমন কিছুর সংস্পর্শে না আসার কারনে তাদের অভিজ্ঞতা সীমিত হয়ে যায়; এই সীমিত অভিজ্ঞতা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে নিরুৎসাহিত করে এবং বিকল্প মতামত বিবেচনার সুযোগ কমিয়ে দেয়। এর ফলে, ব্যবহারকারীদের  ভিন্ন মতের মানুষের সাথে আলোচনা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

সোশ্যাল মিডিয়ার ইকো চেম্বার সমাজের মেরুকরনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বিরোধী মতের লোকদের প্রতি ব্যবহারকারীদের সহনশীলতা কমে যায়, যা মানুষদের মাঝে বিভাজন ও শত্রুতা বাড়ায়। গঠনমূলক আলোচনা এবং সমঝোতার পরিবর্তে ভিন্ন মতের মানুষদের সাথে চরম শত্রুর মত ব্যবহার করা হয়, যার ফলে সমাজের বিভাজন আরও গভীর হয়। 

এই সামাজিক মেরুকরন বিশেষভাবে রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়গুলতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো চরমপন্থী মতামতগুলোকে আরও জোরালো করে তুলে ধরে, যার ফলে ব্যবহারকারীদের আলোচনায় মধ্যপন্থী কন্ঠস্বর প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। এটি কিছু মানুষকে উগ্রপন্থার দিকে ঠেলে দিয়ে তাদেরকে সমাজ ও আশেপাশের মানুষদের জন্য বিপদজনক করে তোলে। 

উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়া  

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আজকাল ব্যাক্তিগত ও পেশাগত পরিবেশে একটি বড় আপদের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা প্রায়ই কাজের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় আপডেট চেক করতে গিয়ে তাদের আসল কাজে মনযোগ হারান এবং এতে তাদের সামগ্রিক দক্ষতা হ্রাস পায়। এটি শুধুমাত্র কর্মক্ষেত্রে ব্যাক্তিগত পারফরম্যান্সকেই প্রভাবিত করে না, বরং দলগত উৎপাদনশীলতাকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। 

শিক্ষার্থীদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার পরীক্ষার ফলাফলে খারাপ প্রভাব ফেলে। ফেসবুকের ফিড স্ক্রল করা বা কনটেন্ট নিয়ে ব্যাস্ত থাকা পড়াশোনার সময় ও শেখার সুযোগ দুটোই কমিয়ে দেয়। এর ফলে প্রায়ই শিক্ষার্থীদের ফলাফল খারাপ হয় এবং শিক্ষার্থী হিসেবে তারা তাদের দ্বায়িত্ব পালন করতে বাধাগ্রস্থ হয়ে থাকে। 

সবসময় নোটিফিকেশন এবং সোশ্যাল মিডিয়া চেক করার প্রবণতা মনযোগ ও কাজের ধারাবাহিকতাকে ব্যাহত করে। এটি কাজের প্রতি মনযোগ ধরে রাখা কঠিন করে তোলে, যার ফলে কাজ শেষ করতে দেরি হয় এবং সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সময়ের সাথে সাথে, এই বদ অভ্যাসগুলো ব্যাক্তিগত ও পেশাগত লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। 

উৎপাদনশীলতার ওপর এই নেতিবাক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর পরিনতি বয়ে আনতে পারে। পেশাগত জীবনে ঘনঘন অন্যমনস্ক হওয়ার প্রবণতা কর্মজীবনে অগ্রগতি এবং উন্নতির সুযোগকে বাধাগ্রস্থ করে। শিক্ষার্থীদের জন্য দুর্বল একাডেমিক পারফরম্যান্স তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও ভালো জায়গায় চাকুরি পাওয়ার সম্ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়।    

শেষ কথা 

পরিশেষে, যদিও ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের আধুনিক জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে, তারপরেও এর অতিরিক্ত ব্যবহার এবং অপব্যবহারের ফলে মানসিক স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা এবং সামাজিক সম্পর্কের উপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার আসক্তি, একাকীত্ব এবং মনযোগের অভাব তৈরি করে; যার ফলে ব্যাক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়।

সোশ্যাল মিডিয়ার এসব ক্ষতিকর প্রভাব এড়িয়ে চলার জন্য ব্যাক্তিগত জীবনে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারন এবং পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে সরাসরি যোগাযোগকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মত স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গ্রহন করা উচিৎ। সচেতনভাবে ব্যবহার করলে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনে ক্ষতির কারন না হয়ে বরং মানুষে মানুষে ইতিবাচক যোগাযোগ এবং ব্যাক্তিগত উন্নতির একটি ভালো মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url