নয়টি বিপজ্জনক রোগের কারন, লক্ষন এবং প্রতিকার
বিভিন্ন প্রকার রোগ সবসময়েই মানুষের স্বাস্থ্যের এবং ভালো থাকার জন্য ঝুঁকি হয় এসেছে, যারমধ্যে কিছু রোগ মানবদেহের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। এই প্রানঘাতী রোগগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং সময়মতো শনাক্ত ও চিকিৎসা না করলে রোগীর জীবনে গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
এই ধরনের রোগগুলো প্রতিরোধ করতে এবং কার্যকর চিকিৎসার জন্য এদের কারন, লক্ষন এবং প্রতিকার সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার। সচেতনতা বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা গ্রহনের মাধ্যমে ব্যাক্তি ও সামাজিকভাবে এসব রোগের সংক্রমণের ঝুঁকি কমিয়ে সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা যায়।
সূচীপত্রঃ নয়টি বিপজ্জনক রোগের কারন, লক্ষন এবং প্রতিকার
ডিপথেরিয়া
ডিপথেরিয়া ব্যাকটেরিয়া জনিত একটি গুরুতর রোগ যা দেহে Corynebacterium diptheriae নামের এক জাতের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমনের ফলে হয়ে থাকে। এটি শ্বাস প্রশ্বাস
নেবার সময় নাক থেকে বেরিয়ে আসা ছোট ছোট পানির ফোঁটার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, আবার
ডিপথেরিয়ার ব্যাকটেরিয়া দিয়ে দূষিত কোনোকিছু স্পর্শ করার মাধ্যমেও এক বা একাধিক
ব্যাক্তি এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এই রোগের ফলে প্রধানত গলা ও নাক আক্রান্ত
হয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ত্বকেও সংক্রমন ঘটতে পারে।
এই রোগের জীবানু শরীরে প্রবেশ করে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে যা শ্বাসযন্ত্রের
টিস্যুর ক্ষতি সাধন করে। অপরিচ্ছন্নতা, টিকাদানের অভাব এবং অতিরিক্ত ভিড়ের
পরিবেশ এই রোগের ঝুঁকি বাড়াতে সাহায্য করে।
শিশু এবং বিশেষ করে যারা ডিপথেরিয়া রোগের টিকা নেননি তাদের এই রোগে আক্রান্ত হবার
সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী হয়ে থাকে।
গলা ব্যাথা, জ্বর এবং প্রচন্ড শারীরিক দুর্বলতা এই রোগের সাধারন লক্ষণ হিসেবে
দেখা দেয়। এছাড়াও রোগীর গলায় একটি ঘন, ধূসর ঝিল্লি তৈরি হতে পারে যার ফলে শ্বাস
নেওয়া এবং গিলতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। জটিল অবস্থায় এটি হৃদপিণ্ড এবং
স্নায়ুতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, এর ফলে রোগী মারাও যেতে পারে।
ডিপথেরিয়া চিকিৎসায় ব্যাকটেরিয়া থেকে উৎপন্ন করা বিষাক্ত পদার্থ নিষ্ক্রিয় করতে
রোগীকে অ্যান্টিটক্সিন দেওয়া হয়। ইনফেকশন দূর করতে পেনিসিলিন বা ইরিথ্রোমাইসিনের
মতো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। রোগীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকলে,
রোগীকে প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করে কৃত্তিমভাবে শ্বাসযন্ত্রের সহায়তা দেওয়া হতে
পারে।
ডিপথেরিয়া থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো DTP বা DTaP টিকা গ্রহন করা।
ব্যাক্তিগত এবং বাসস্থানের চারিপাশের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে এবং
আক্রান্ত ব্যাক্তির সংস্পর্শ এড়ানোর মাধ্যমে এই রোগের ব্যাপক হারে সংক্রমনের
ঝুঁকি কমানো যায়। ডিপথেরিয়া নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির
মাধ্যমে এই রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
টাইফয়েড
টাইফয়েড জ্বর একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমন যা Salmonella Typhi নামের এক
ধরনের জীবানুর কারনে হয়ে থাকে। এটি প্রধানত দূষিত খাবার এবং পানির মাধ্যমে ছড়ায়,
বিশেষ করে যেখানে স্যানিটেশন ব্যাবস্থা খুব একটা ভালো নয়। এই রোগ মূলত
পরিপাকতন্ত্রকে আক্রান্ত করে, তবে যথাযথ সময়ে সঠিক চিকিৎসার অভাবে এটি শরীরের
অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
Salmonella Typhi যুক্ত মল দ্বারা দূষিত খাবার খাওয়া বা পানি পান করা
টাইফয়েড রোগের প্রধান কারন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অপরিচ্ছন্নতা, বিশুদ্ধ পানির
অভাব এবং অনিরাপদ স্যানিটেশন ব্যাবস্থা সংক্রমনের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।
জনস্বাস্থ্য ব্যাবস্থা দুর্বল হওয়ার কারনে তাই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টাইফয়েড রোগের
প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।
দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, শারীরিক দুর্বলতা এবং পেটে ব্যাথা টাইফয়েড রোগের প্রধান
লক্ষণগুলো হয়ে থাকে। এছাড়াও রোগীরা ডাইরিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্ষুধামন্দা এবং
মাথাব্যাথার শিকার হতে পারেন। গুরুতর ক্ষেত্রে অন্ত্রে ছিদ্র হয়ে অভ্যন্তরীণ
রক্তক্ষরন হওয়ার কারনে রোগীর জীবনে সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
টাইফয়েড রোগের চিকিৎসায় সাধারনত সিপ্রোফ্লক্সাসিন (Ciprofloxacin) এবং
অ্যাজিথ্রোমাইসিনের (Azithromycin) এর মতো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। একই
সাথে রোগীকে প্রচুর পরিমানে বিশুদ্ধ পানি পান এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ
দেওয়া হয়। জটিল অবস্থায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে শিরায় তরল গ্রহন করতে হতে
পারে।
টাইফয়েড প্রতিরোধ করার জন্য পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, বিশুদ্ধ পানি পান
করা এবং দূষিত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। টাইফয়েড রোগ হবার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে এমন
জায়গায় ভ্রমন করার আগে টাইফয়েডের টিকা নেওয়া উচিৎ। জনস্বাস্থ্য উদ্যেগ, যেমন
স্যানিটেশন ব্যাবস্থার উন্নয়ন এবং নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা, টাইফয়েডের বিস্তার
কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
টিটেনাস
টিটেনাস Clostridium tetani নামের এক প্রকারের ব্যাকটেরিয়ার কারনে সৃষ্টি
হওয়া একধরনের গুরুতর ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ। এই ব্যাকটেরিয়া সাধারনত ত্বকের কেটে
যাওয়া জায়গা, বিশেষ করে মরিচা ধরা লোহার টুকরোর মতো দূষিত বস্তু থেকে তৈরি হওয়া
ক্ষত বা ফুটো হওয়া ঘায়ের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। শরীরে প্রবেশের পর এটি দ্রুত
হারে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে এবং একই সাথে এরা একধরনের বিষাক্ত পদার্থ উৎপন্ন করে,
যা স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমন করে এবং মাংসপেশিগুলোকে সংকুচিত করে টান টান অবস্থায়
শক্ত করে ধরে রাখে।
Clostridium tetani এর স্পোর বা বীজের সংস্পর্শে আসা টিটেনাস রোগের প্রধান
কারন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে; এই স্পোরগুলো সাধারনত মাটি, ধূলিকণা এবং প্রাণির
মলে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। গভীর বা পচে যাওয়া ক্ষত, পোড়া স্থান এবং অপরিচ্ছন্ন
অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে
টিকা না নেওয়া ব্যাক্তিরা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
শরীরের বিভিন্ন মাংসপেশি হঠাৎ হঠাৎ টেনে ধরা, গিলতে সমস্যা হওয়া এবং বিশেষ করে
চোয়াল ও ঘাড়ের পেশিতে বেদনাদায়ক খিঁচুনি হওয়া টিটেনাসের প্রধান লক্ষন হয়ে থাকে।
গুরুতর ক্ষেত্রে, এই খিঁচুনি সারা দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং শ্বাস প্রশ্বাসে
সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যথাসময়ে চিকিৎসা না করা হলে, এটি ফুসফুস কে অকার্যকর
করে দিয়ে রোগীর মৃত্যুর কারন হতে পারে।
টিটেনাস রোগের চিকিৎসায় ক্ষতস্থান দ্রুত পরিষ্কার করে রোগীকে টিটেনাস
অ্যান্টিটক্সিন দেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা সাধারণত রোগীকে পেশী শিথিলকারী ওষুধ
এবং অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর মাধ্যমে এই রোগের প্রভাবগুলোকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে
আসার চেষ্টা করেন। জটিল অবস্থায় রোগীকে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যায় কৃত্তিম ভাবে
শ্বাস প্রশ্বাস দিতে হতে পারে।
টিটেনাস প্রতিরোধ করার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো টিটেনাস টক্সয়েড (TT) টিকা
গ্রহণ করা, যা সাধারণত DTP বা Td টিকা সিরিজের অংশ হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে।
ক্ষতস্থান জীবাণুনাশক তরল দিয়ে পরিস্কার রাখা এবং আঘাত পাওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসা
নেওয়া টিটেনাসের সংক্রমনের ঝুঁকি কমায়। সরকার থেকে নিয়মিত টিকাদান কর্মসুচি এবং
পরিচ্ছন্নতার প্রচার সংক্রান্ত জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম টিটেনাস প্রতিরোধে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পার্টুসিস (হুপিং কফ)
পার্টুসিস, যা হুপিং কফ নামেই বেশি পরিচিত, Bordetella pertussis নামের এক
ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমনে সৃষ্টি হওয়া এক ধরনের মারাত্বক ছোঁয়াচে রোগ। এটি
আক্রান্ত ব্যাক্তির হাঁচি এবং কাশির মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগ প্রধানত
শ্বাসনালী এবং ফুসফুসকে আক্রান্ত করে এবং তীব্র কাশির আক্রমন সৃষ্টি করে।
Bordetella pertussis শ্বাসনালীর ভেতরের দেয়ালে লেগে থেকে বিষাক্ত পদার্থ
নির্গত করে যা পার্টুসিস রোগের প্রধান কারন। এই বিষাক্ত পদার্থগুলো শ্বাসনালীর
মাংসগুলো ফুলিয়ে তুলে ব্যাপকে আকারে সর্দি উৎপন্ন করতে শুরু করে। টিকা না নেওয়া
ব্যাক্তিরা, বিশেষ করে শিশু ও নবজাতকেরা এই রোগের গুরুতর সংক্রমনের ঝুঁকিতে
থাকে।
হালকা সর্দি, হালকা জ্বর এবং হাঁচি কাশির মত সাধারন উপসর্গ দিয়ে পার্টুসিস রোগের
সংক্রমন ঘটে থাকে। রোগ বাড়ার সাথে সাথে তীব্র কাশির আক্রমন দেখা যায়, একই সাথে
শ্বাস নেবার সময় বুকের ভেতর থেকে "হুপিং" শব্দ শোনা যেতে পারে। রোগ আরও গুরুতর
হলে, রোগীর দেহে নিউমোনিয়া, খিঁচুনি এবং শ্বাসকষ্টের মতো জটিলতা দেখা দিতে
পারে।
পার্টুসিসের চিকিৎসায় সাধারনত অ্যাজিথ্রোমাইসিন বা ইরিথ্রোমাইসিনের মতো
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার করা হয়। একই সাথে রোগীদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম, প্রচুর তরল
পান এবং কাশি কমানোর জন্য হিউমিডিফায়ার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। মারাত্বক
ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শিশুদের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন হতে পারে।
পার্টুসিস প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো DTaP বা TDap টিকা গ্রহন করা।
ব্যাক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং আক্রান্ত ব্যাক্তির সংস্পর্শ এড়ানোর
মাধ্যমে এই রোগের ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়া রোধ করা যায়। এছাড়াও টিকাদান কর্মসূচি
এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পার্টুসিসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসা
সম্ভব।
পোলিও
পোলিও, বা পোলিওমেলাইটিস, একটি ভাইরাসজনিত অত্যন্ত সংক্রামক রোগ যা পোলিওভাইরাসের
কারনে হয়ে থাকে। পোলিওভাইরাস দ্বারা দূষিত খাবার, পানি বা আক্রান্ত ব্যাক্তির
সংস্পর্শের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। এই ভাইরাস প্রধানত স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমন করে
এবং মারাত্বক ক্ষেত্রে পক্ষাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
পোলিওর প্রধান কারন পোলিওভাইরাস মুখের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং অন্ত্রে
ব্যাপক হারে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। অপরিচ্ছন্নতা, বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং
অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এর সংক্রমনের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ করে ছোট শিশু এবং টিকা না
নেওয়া ব্যাক্তিরা এই রোগে আক্রান্ত হবার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
পোলিওর লক্ষ্মণ এই রোগের সংক্রমনের মাত্রার উপর নির্ভর করে এবং এটি রোগীকে হাল্কা
থেকে মারাত্মকভাবে ক্ষতি সাধন করতে পারে। হালকা সংক্রমনে জ্বর, গলা ব্যাথা এবং
ক্লান্তি দেখা দিতে পারে, তবে গুরুতর ক্ষেত্রে এটি পেশি দুর্বলতা ও পক্ষাঘাত
সৃষ্টি করতে পারে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায়, পোলিও শ্বাসযন্ত্র বিকল করে রোগীকে
স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দেয়; এর ফলে রোগী মারা যেতে পারে।
পোলিওর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তবে ফিজিক্যাল থেরাপি, ব্যাথানাশক ওষুধ এবং
কৃত্তিমভাবে শ্বাস প্রশ্বাসে সহায়তা রোগীদের উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে। আক্রান্ত
ব্যাক্তিদের বিশ্রাম নেওয়া এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর খাবার
খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে রোগী স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেলে,
পুনর্বাসনের জন্য দেওয়া ফিজিক্যাল থেরাপি রোগীর চলাচলের সক্ষমতা এবং জীবনমান
উন্নত করতে পারে।
পোলিও প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো মুখে খাওয়ার পোলিও টিকা (OPV) বা ইন
আক্টিভেটেড পোলিও টিকা (IPV) গ্রহন করা। সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে পরিচ্ছন্নতা বজায়
রাখা, বিশুদ্ধ পানি পান করা এবং স্যানিটেশন ব্যাবস্থা উন্নত করার কোন বিকল্প নেই।
সুখের বিষয় হলো, বিশ্বব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি পোলিও রোগের সংখ্যা
উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে এনেছে এবং এর ফলে বর্তমানে পৃথিবীতে পোলিও রোগ বিলুপ্তির
প্রায় কাছাকাছি চলে গেছে।
হাম
হাম একটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে ভাইরাসজনিত রোগ, যা Measles morbillivirus নামের একধরনের ভাইরাসের আক্রমনে ঘটে থাকে এবং শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে এটি
বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত শিশুরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হলেও, টিকা না নেওয়া
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। জনবহুল স্থান এবং কম
টিকাদানের হারবিশিষ্ট এলাকায় এই রোগ দ্রত ছড়িয়ে পড়ে।
হামের প্রাথমিক লক্ষণগুলো (জ্বর, কাশি, সর্দি ও পানিপূর্ণ লাল চোখ) সাধারনত
সংক্রমনের ১০-১৪ দিন পরে প্রকাশ পায়। কিছুদিন পরে মুখের ভেতরে কোপলিক স্পটস্
(Koplik's sopts) নামের ছোট ছোট সাদা দাগ দেখা যেতে পারে যা হাম নিশ্চিত করার
প্রধান চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়। এরপর শরীরের বিভিন্ন অংশে লালচে ফুসকুড়ি বা র্যাশ
ছড়িয়ে পড়ে।
হাম থেকে সৃষ্ট হওয়া জটিলতা রোগীর জন্য ভয়াবহ হতে পারে; রোগীর নিউমেনিয়া,
এনসেফালাইটিস (মস্তিস্ক ফুলে যাওয়া), এবং গুরুতর পর্যায়ে মৃত্যু হতে পারে।
অপুষ্টিতে ভোগা শিশু এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার লোকেরা হামে আক্রান্ত হবার
সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। গর্ভবতী মহিলাদের হাম হলে বাচ্চা নষ্ট হওয়া বা
অপরিনত শিশুর জন্মের ঝুঁকি থাকে।
হাম প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো MMR (হাম, মাম্পস্ ও রুবেলা) টিকা
নেওয়া। জনগনের একটি বড় অংশ টিকা নিলে হার্ড ইমুউনিটি (Herd Immunity) তৈরি হয়, যা
শুধু হাম নয় বরং অন্যান্য সংক্রামক রোগ ছড়ানো কমায় এবং টিকা নিতে অক্ষম
ব্যাক্তিদের অসুস্থ হওয়া থেকে বাঁচায়। নিয়মিত হাত ধোয়া এবং হাঁচি-কাশির সময় মুখ
ঢেকে রাখা হামের সংক্রমন কমাতে সহায়ক হতে পারে।
হামের কোন নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ না থাকার কারনে এর লক্ষণগুলো উপশম করাই
এর প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি হয়ে থাকে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া, প্রচুর পানি পান করা
এবং জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল বা অনুরুপ ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। গুরুতর
অবস্থায়, রোগের জটিলতা কমাতে এবং মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাস করতে রোগীকে ভিটামিন-এ
সাপ্লিমেন্ট খাওয়ানো যেতে পারে।
দুঃখের বিষয় হলো, হাম এখনো টিকা না নেওয়া জনগোষ্টীর জন্য একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য
সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রাথমিক সনাক্তকরন, যথাযথ চিকিৎসা এবং ব্যাপক
টিকাদান কর্মসূচি হামের মতো সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা
পালন করে। সঠিক জনস্বাস্থ্য উদ্যোগের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে হামের প্রকোপ অনেকাংশে
কমিয়ে আনা সম্ভব।
যক্ষা
যক্ষা বা TB হলো Mycobacterium tuberculosis নামক ব্যাকটেরিয়া
দ্বারা সৃষ্ট একটি মারাত্বক রকমের সংক্রামক রোগ। এই ব্যাকটেরিয়া মূলত
ফুসফুসকে আক্রান্ত করলেও , এরা মস্তিস্ক, মেরুদন্ডসহ শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে
পড়তে পারে। আক্রান্ত রোগীর হাঁচি, কাশি বা কথা বলার সময় মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ছোট,
ছোট পানির ফোঁটার মাধ্যমে যক্ষা ছড়িয়ে পড়ে।
যক্ষার মূল কারণ হলো সংক্রমিত ব্যক্তির কাছ থেকে সুস্থ ব্যাক্তির দেহে
ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের যক্ষা হওয়ার
সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এছাড়াও অপর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যাবস্থা, জনসংখ্যার ঘনত্ব
এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাও এই রোগের বিস্তার বাড়াতে সাহায্য করে।
তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে স্থায়ী কাশি, বুকে ব্যাথা এবং রক্তসহ কাশি হওয়াকে
যক্ষার সাধারন উপসর্গ হিসেবে গন্য করা হয়ে থাকে। অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে
জ্বর হওয়া, রাতে ঘুমানোর সময় সারা শরীর ঘামে ভিজে যাওয়া, রোগীর ওজন কমে যাওয়া এবং
শারীরিক দুর্বলতা বোধ করা। সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসা না হলে যক্ষা মারাত্বক হয়
উঠতে পারে এবং রোগীর মৃত্যুর কারন হতে পারে।
যক্ষা শনাক্ত করার জন্য ম্যানটোক্স টিউবারকুলিন স্কিন টেস্ট (Mantoux Tuberculin
Skin Test), বুকের এক্স রে নেওয়া এবং কফ পরীক্ষার মতো বিভিন্ন মেডিকেল টেস্ট করা
হয়। প্রাথমিক অবস্থায় যক্ষা ধরা পড়লে এটির প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা সহজতর হয়ে থাকে।
সাধারনত যক্ষার চিকিৎসায় ছয় মাস বা তার বেশি সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহন করতে
হয়।
যক্ষা প্রতিরোধের জন্য টিকাদান, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরন করা এবং জনসংখার ঘনত্ব
কমানোর জন্য ব্যাবস্থা নেওয়া জরুরি। বিসিজি (BCG) টিকা গুরুতর যক্ষা প্রতিরোধ
করতে সাহায্য করে, একই সাথে এটি শিশু ও নবজাতকদের যক্ষার হাত থেকে বাঁচাতে
গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করে। পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহন করা, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ
নির্নয় এবং চিকিৎসা সম্পূর্ণ করা যক্ষা নিয়ন্ত্রন ও নিরাময়ের জন্য অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ।
পীতজ্বর
পীতজ্বর বা Yellow Fever একধরনের ভাইরাসজনিত রোগ, যা Flavivirus দ্বারা
আক্রান্ত Aedes ও Haemagous প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এই
রোগের প্রাদুর্ভাব মূলত আফ্রিকা ও দক্ষিন আমেরিকার গ্রীস্মমন্ডলীয় এবং
উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। গুরুতর সংক্রমনে রোগীর ত্বক ও চোখ হলুদ
হয়ে যাবার কারনে এই রোগকে পীতজ্বর বা Yellow Fever ও বলা হয়ে
থাকে।
সংক্রমিত মশার কামড়ে মানুষের দেহে ভাইরাস প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধি করতে থাকা
পীতজ্বরের মূল কারন হিসেবে বিবেচিত হয়। যেসব জায়গায় মশা বেশি সেসব জায়গায় বিশেষ
করে বর্ষাকালে এই ভাইরাস বেশী বিস্তার লাভ করে। অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও
টিকার অভাব এই রোগের প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়।
এই রোগের উপসর্গগুলো হালকা থেকে গুরুতর হতে পারে। প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবে রোগীর
জ্বর, ঠাণ্ডা লাগা, মাথাব্যাথা, পেশির ব্যাথা, বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে।
গুরুতর অবস্থায় রোগির অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যেতে পারে, অভ্যন্তরীণ
রক্তপাত হয়ে রোগী মারা যেতে পারে।
পীতজ্বর সাধারনত রোগীর উপসর্গ, ভ্রমনের ইতিহাস পর্যবেক্ষন করে এবং রক্ত পরিক্ষার
মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়ে থাকে। এই রোগের কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা না থাকলেও,
সাপোর্টিভ কেয়ার, যেমন রোগীর জ্বর কমানোর জন্য কপালে ভিজা কাপড় দেওয়া ও ব্যথা
নিয়ন্ত্রনের জন্য ওষুধ খাওয়া এই রোগের উপসর্গগুলোর তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে।
জটিল অবস্থায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা এবং নিবিড় চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হতে
পারে।
পীতজ্বর প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকা নেওয়া; এই টিকা অধিকাংশ মানুষকে
আজীবন সুরক্ষা প্রদান করে। মশা নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা, যেমন মশা প্রতিরোধক স্প্রে
বা কয়েল ব্যবহার করা, রাতে মশারী টাঙ্গীয়ে ঘুমোতে যাওয়া, সারা গা ঢেকে রাখে এমন
পোশাক পরিধান করা, এই রোগের সংক্রমনের ঝুঁকি কমায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক রোগ
নির্নয় ও চিকিৎসা গ্রহন করলে পীতজ্বরে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব।
MRSA
মেথিসিলিন-প্রতিরোধী Staphylococcus aureus (MRSA) একধরনের ব্যাকটেরিয়ার
সংক্রমন, যাকে অনেক শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও সারানো সম্ভব হয় না। এটি
Staphylococcus aureus এর একটি বিবর্তিত রূপ, যা আজকাল সাধারন
অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসাকে অকার্যকর করে তুলছে। MRSA সংক্রমিত ক্ষতস্থান, দূষিত
পৃষ্ঠতল বা এর দ্বারা আক্রান্ত ব্যাক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে
ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বর্তমান চিকিৎসা ব্যাবস্থায় ছোট-খাট, সামান্য ব্যাপারেও অ্যান্টিবায়োটিকের
অতিরিক্ত বা ভুল ব্যাবহার, যা ধীরে ধীরে ব্যাকটেরিয়াদেরকে অ্যান্টিবায়োটিক
প্রতিরোধী করে তুলছে, MRSA সংক্রমনের প্রধান কারন হিসেবে গন্য হয়ে আসছে।
হাসপাতাল, নার্সিং হোম এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলি MRSA ছড়ানোর
প্রধান স্থান হিসেবে গন্য হয়ে থাকে; এই সকল স্থানে ভর্তি হয়ে থাকা লোকেদের রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই দুর্বল থাকার কারনে এই ব্যাকটেরিয়া সহজে তাদেরকে
আক্রান্ত করে। অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি এবং সঠিকভাবে ক্ষত পরিস্কার না করাও এই
ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারে ভূমিকা পালন করে।
MRSA সংক্রমণের উপসর্গগুলো আক্রান্ত স্থানের উপর নির্ভর করে। এর সাধারন
উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষতস্থান লালচে হয়ে ফুলে যাওয়া এবং ব্যাথাযুক্ত ত্বকের
সংক্রমন, যা থেকে প্রায়ই পুঁজ নিঃসৃত হতে থাকে। গুরুতর ক্ষেত্রে, MRSA
রক্তপ্রভাবে প্রবেশ করে জ্বর, শীতল অনুভূতি এবং নিউমোনিয়া বা সেপসিসের মত
প্রাণঘাতী জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
MRSA শনাক্ত করতে সংক্রমিত ক্ষত থেকে ব্যাকটেরিয়া কালচার অথবা নাকের ভেতর থেকে
নমুনা সংগ্রহ (Nasal Swab) করে পরীক্ষা করা হয়। এর চিকিৎসায় MRSA প্রতিরোধ করতে
এখনো সক্ষম এমন কিছু বিশেষ অ্যান্টিবায়োটিক যেমন ভ্যানকোমাইসিন (Vancomycin) বা
লাইনজোলিড (Linezolid) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে, চিকিৎসকেরা রোগীকে
অ্যান্টিবায়োটিক না দিয়েই MRSA দ্বারা সংক্রমিত ফোঁড়া নিস্কাশন করেন।
MRSA প্রতিরোধ করার জন্য নিয়মিত হাত ধোয়া এবং ক্ষতস্থান পরিস্কার এবং ঢেকে রাখার
মতো ভালো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসায় অপ্রয়োজনীয়
অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এড়ানো এবং হাসপাতাল ও জনসমাগমস্থল পরিস্কার রাখা
সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক রোগ নির্নয় ও চিকিৎসা
MRSA সংক্রমন নিয়ন্ত্রন এবং এর থেকে সৃষ্টি হওয়া জটিলতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে।
শেষ কথা
সবশেষে বলা যায়, এই আর্টিকেলে উল্লেখ করা বিপজ্জনক রোগগুলো মানব স্বাস্থ্যের জন্য
বড় হুমকি তৈরি করলেও, তাদের কারন, লক্ষন ও প্রতিকার সম্পর্কে জানা গেলে এই সকল
রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। দ্রত শনাক্তকরন ও সঠিক চিকিৎসা এই
রোগগুলোর প্রভাব কমাতে এবং জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, যথাযথ পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং টিকাদান
সম্পর্কে সচেতন থাকা এসব রোগের বিস্তার রোধে সহায়ক হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে, এই রোগগুলোর প্রকোপ কমতে
শুরু করবে।
আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url