ব্রন থেকে মুক্তি পাবার প্রাকৃতিক উপায়গুলো
ব্রন ত্বকের অন্যতম একটি সাধারন সমস্যা যা আমাদের সবাইকেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে থাকে। সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও খাদ্যাভ্যাস, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, মানসিক চাপ এবং পরিবেশগত অবস্থার মত বিভিন্ন কারনে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাক্তিদের মধ্যেও এটি বজায় থাকতে পারে।
এই আর্টিকেলে ব্রনের সমস্যা দূর করার জন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ভেষজ চিকিৎসা, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, জীবনধারার পরিবর্তন এবং ত্বকের যত্ন সম্পর্কিত বিভিন্ন অভ্যাস। এই প্রাকৃতিক উপায়গুলোর সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা বোঝার মাধ্যমে আমি আশা করছি পাঠকেরা তাদের ত্বকের যত্ন এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন।
সুচিপত্রঃ ব্রন থেকে মুক্তি পাবার প্রাকৃতিক উপায়গুলো
ব্রন হবার কারণগুলো
ব্রন থেকে মুক্তি পাবার প্রাকৃতিক উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করার আগে, কি কারনে
আমাদের ব্রন হয়ে থাকে তা জানা গুরুত্বপূর্ন। এই কারণগুলো বোঝা গেলে ব্রন সৃষ্টির
নির্দিষ্ট কারণগুলোকে লক্ষ্য করে কার্যকর প্রাকৃতিক প্রতিকার নির্ধারন করা সহজ
হয়। যে কারণগুলোর জন্য সাধারনত আমাদের ত্বকে ব্রনের প্রাদুভার্ব দেখা দিতে পারে
সেগুলো হলোঃ
অতিরিক্ত তেল উৎপাদনঃ ত্বকের নিচে অবস্থান করা সেবাসিয়াস গ্রন্থিগুলোর দ্বারা অতিরিক্ত সেবাম
(ত্বকের তেল) তৈরি হলে সেগুলো আমাদের লোমকূপে আটকে গিয়ে লোমকূপকে বন্ধ করে রাখে,
যার ফলে সেখানে ময়লা এবং ব্যাকটেরিয়া জমতে শুরু করে। এই অতিরিক্ত তেল এমন একটি
পরিবেশ তৈরি করে যেখানে ব্রন সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া সহজেই বংশ বৃদ্ধি করতে পারে।
এর ফলে ত্বকের বিভিন্ন অংশ লাল হয়ে ফুলে ওঠে, যা থেকে বিভিন্ন ধরনের ব্রনের
সৃষ্টি হয়।
রন্ধ্র বন্ধ হওয়াঃ মৃত ত্বকের কোষ এবং অতিরিক্ত তেল একসাথে জমা হয়ে চুলের গোড়া বা
ফলিকলগুলিকে অবরুদ্ধ করতে পারে। এই অবরুদ্ধতা ত্বকের স্বাভাবিক কোষ ঝরে পড়ার
প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে, যার ফলে ত্বকে হোয়াইটহেড, ব্ল্যাকহেড এবং পিম্পল
তৈরি হয়। সময়ের সাথে সাথে, এই বন্ধ রন্ধ্রগুলিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ব্রনের
অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে।
ব্যাকটেরিয়াজনিত কারনঃ Propionibacterium acnes (P. acnes) একটি সুপরিচিত প্রজাতির
ব্যাকটেরিয়া যা আমাদের ত্বকে বসবাস করে থাকে, তবে এটি বন্ধ হয়ে যাওয়া লোমকূপে
আটকে গেলে সমস্যা তৈরি হয়। এই অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া দ্রত বৃদ্ধি পেয়ে শরীরের রোগ
প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে সজাগ করে দেয়, যার ফলে আক্রান্ত স্থানে প্রদাহ সৃষ্টি হয়ে
থাকে। এর ফলে লাল, ফোলা এবং অনেক সময় বেদনাদায়ক ব্রন দেখা দিতে পারে যা নিরাময়
করা কঠিন হয়ে পড়ে।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতাঃ কৈশোর, গর্ভধারন এবং পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে শরীরে হরমোনের ওঠানামা ত্বকে
তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়ে ত্বককে অতিরিক্ত তৈলাক্ত করে তুলতে পারে। বিশেষ করে
আন্ড্রোজেন নামের একধরনের হরমোন ত্বকের নিচের সেবাসিয়াস গ্রন্থিগুলোকে অতিরিক্ত
সেবাম বা তেল উৎপাদনের জন্য উদ্দীপিত করে থাকে, যা ত্বকের ব্রন হবার প্রবণতা
বাড়ায়। এই কারনেই জীবনের নির্দিষ্ট সময়ে অনেক মানুষ ব্রনের সমস্যার সম্মুখিন
হন।
খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারাঃ উচ্চ গ্লাইসেমিক সমৃদ্ধ খাবার (যেমন, সাদা ভাত, কেক, সফট ড্রিঙ্ক
ইত্যাদি), দুগ্ধজাত পণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত চিনি অতিরিক্ত পরিমানে গ্রহন করলে
রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে গিয়ে ত্বকের প্রদাহ এবং অতিরিক্ত তেল উৎপাদন বেড়ে যেতে
পারে। অপরদিকে মানসিক চাপ এবং ঘুমের অভাব শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, যার
ফলে ব্রনের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বজায়
রাখলে ব্রন নিয়ন্ত্রনে রাখা সহজ হয়।
ব্রন দূর করতে ভেষজ চিকিৎসা
ব্রনসহ ত্বকের বিভিন্ন সমস্যার জন্য শত শত বছর ধরে ভেষজ চিকিৎসা ব্যবহৃত হয়ে
আসছে। ব্রন প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর কিছু প্রাকৃতিক চিকিৎসার মধ্যে রয়েছেঃ
টি ট্রি অয়েলঃ টি ট্রি অয়েলে (Tea tree oil) শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়া এবং ত্বকের ফুলে ওঠা
প্রতিরোধী উপাদান থাকার কারনে এটি ব্রনের চিকিৎসায় একটি কার্যকর প্রতিকার হিসেবে
কাজ করে। গবেষনায় দেখা গেছে, ৫% টি ট্রি অয়েলের জলীয় দ্রবন সাধারন ব্রন চিকিৎসায়
ব্যবহৃত উপাদান বেঞ্জয়েল পারক্সাইডের (Benzoyl Peroxide) মতোই কার্যকর হতে পারে,
এটি ত্বককে অতিরিক্ত শুষ্ক করে বিরক্তিকর চুলকানির জন্ম দেয় না। ব্যবহার
করার জন্য টি ট্রি অয়েলকে একটি ক্যারিয়ার অয়েলের (যেমন নারিকেল তেল) সাথে
মিশিয়ে নিন এবং তুলার কাঠির সাহায্যে আক্রান্ত স্থানে ধীরে ধীরে প্রয়োগ
করুন।
অ্যালোভেরাঃ অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী গাছের পাতা এর
প্রশান্তিদায়ক এবং নিরাময়কারী গুনের জন্য অনেক আগে থেকেই পরিচিত হয়ে এসেছে। এটি
ব্রণের সাথে সম্পর্কিত প্রদাহ, ত্বকের লালচেভাব এবং ফুলে ওঠা কমাতে সহায়তা করে।
অ্যালোভেরা জেল সরাসরি ত্বকের ব্রনপ্রবন স্থানে প্রয়োগ করা যেতে পারে বা আরও ভালো
ফল পাবার জন্য একে টি ট্রি অয়েলের সাথে মিশিয়েও ব্যবহার করা যেতে
পারে।
গ্রিন টি এক্সট্রাক্টঃ গ্রিন টি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদানে সমৃদ্ধ
থাকার কারনে, তা লোমকুপ থেকে উৎপন্ন হওয়া তেলের (Sebum) পরিমান কমাতে এবং ত্বকে
ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করে। ঠাণ্ডা পানিতে গ্রিন টি মিশিয়ে
সরাসরি ত্বকে প্রয়োগ করে অথবা গ্রিন টি সমৃদ্ধ স্কিন কেয়ার পণ্য ব্যবহার করে
ত্বকে ব্রনের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রনে আনা যেতে পারে।
উইচ হ্যাজেলঃ উইচ হ্যাজেল (Witch hazel) একটি প্রাকৃতিক অ্যাস্ট্রিনজেন্ট (এমন একধরনের
পদার্থ বা ওষুধ যা শরীরের টিস্যুর সংকোচন ঘটায়, রক্ত প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে)
যা ত্বকের রন্ধ্র সংকুচিত করতে, প্রদাহ কমাতে এবং অতিরিক্ত তেল দূর করতে সাহায্য
করে। এটি ত্বক পানি দিয়ে ধুয়ে নেবার পরে তুলার প্যাডের মাধ্যমে ত্বকে লাগানো যেতে
পারে।
ব্রনমুক্ত ত্বকের জন্য খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
আমরা আমদের দৈনন্দিন জীবনে কি খাচ্ছি তা আমাদের ত্বকের স্বাস্থ্যের উপর
গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে, এবং কিছু খাবার ব্রন সৃষ্টি করতে পারে আবার কিছু খাবার
ব্রন কমাতেও সহায়তা করতে পারে। সঠিকভাবে খাদ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা দেহে
হরমোন নিয়ন্ত্রন, প্রদাহ হ্রাস এবং ত্বকের পরিচ্ছন্নতা উন্নত করতে পারি। পুষ্টিকর
খাবার গ্রহন করার দিকে মনযোগ দিলে তা ত্বকের স্বাস্থ্যের অভ্যন্তরীণ উন্নতি ঘটিয়ে
ব্রনকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসা সম্ভব হতে পারে।
চিনি ও উচ্চ-গ্লাইসেমিক খাবার কমানোঃ সাদা রুটি, চিনি-যুক্ত পানীয় এবং ফার্ষ্টফুড এর মতো উচ্চ-গ্লাইসেমিক খাবার
রক্তে শর্করার পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় শরীরের প্যানক্রিয়াস
নামের গ্রন্থি ইনসুলিন উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে যার ফলে ত্বকে অতিরিক্ত তেল নিঃসরণ ও
প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে; এরকম অবস্থা ত্বকে ব্রন সৃষ্টি করার জন্য আদর্শ পরিবেশ
গড়ে তোলে। এই খাবারগুলোর পরিবর্তে পূর্ণ শস্য, আঁশযুক্ত সবজি এবং কম চর্বিযুক্ত
মাংস খেলে রক্তে শর্করার ভারসাম্য বজায় থাকে এবং এর ফলে ত্বক পরিস্কার
থাকে।
দুগ্ধজাত খাবার কমানোঃ দুগ্ধজাত খাবার,
বিশেষ করে দুধে, এমন হরমোন রয়েছে যা সেবাম (ত্বকের তেল) উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়ে ব্রন
সৃষ্টি করতে পারে। গবেষনায় দেখা গেছে যে স্কিমড্ মিল্ক (কম চর্বিযুক্ত দুধ) ফুল
ক্রিম দুধের তুলনায় ব্রন সৃষ্টিতে বেশি ভূমিকা রাখে, কারণ এতে কিছু বায়ো অ্যাকটিভ
যৌগ বেশি পরিমানে থাকে। নারিকেল দুধ, ওট মিল্ক বা সোয়া দুধের মতো উদ্ভিজ্জ বিকল্প
গ্রহন করলে ব্রনের প্রবণতা কমতে পারে, এবং ত্বকের ভারসাম্য উন্নত হতে পারে।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড যুক্ত খাবার খাওয়াঃ শিং, বোয়াল, পাবদা, মাগুর এবং ইলিশের মতো চর্বিযুক্ত মাছের মধ্যে থাকা
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শক্তিশালী ব্রন প্রতিরোধী গুনাবলী বহন করে। এই উপকারী
ফ্যাট ত্বকের তেল উৎপাদন নিয়ন্ত্রন করতে, লালচে ভাব কমাতে ও ব্রন সংক্রান্ত ফুলে
ওঠা হ্রাস করতে সাহায্য করে। খাদ্য তালিকায় লাল শাক, পালং শাক, চিয়া সিড, আখরোট
যোগ করলে দেহ পর্যাপ্ত পরিমানে ওমেগা-৩ গ্রহন করার কারনে ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো
থাকবে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়াঃ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর ফল ও সবজি ফ্রি র্যাডিকেলের কারনে সৃষ্ট হওয়া
অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে ত্বককে রক্ষা করে। লেবু, পালং শাক ও গাজরের মত খাবারে
থাকা ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ব্রন জনিত ত্বকের ফোলা কমাতে এবং কোলাজেন উৎপাদন
বাড়াতে সাহায্য করে। বিভিন্ন রঙয়ের পুষ্টিকর খাবার গ্রহন করলে ত্বকের টোন,
টেক্সচার ও সামগ্রিক সৌন্দর্যের উন্নতি ঘটে।
ব্রন প্রতিরোধে জীবনধারার পরিবর্তন
খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাস ব্রন হওয়া এবং তা কতখানি
তীব্র হবে তার উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। দৈনন্দিন রুটিন, মানসিক চাপের
মাত্রা এবং ঘুমের গুনমান ত্বকের সুস্থ্যতা বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
আমাদের জীবনে ছোট অথচ কার্যকর কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমে আমরা ব্রন কমানো এবং
ত্বকের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করতে পারি।
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রনে রাখাঃ মানসিক চাপ দেহে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলে ত্বকের তেল
গ্রন্থিগুলকে অতিরিক্ত সক্রিয় করে তোলে, যার ফলে ত্বকে ব্রনের প্রাদুর্ভাব বেড়ে
যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী স্ট্রেস শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে আগে থেকে
তৈরি হওয়া ব্রণগুলো আরও খারাপ অবস্থায় চলে যেতে পারে এবং ত্বকের নিরাময় প্রক্রিয়া
ধীর হয়ে যায়। ধ্যান, যোগব্যায়াম, গভীর শ্বাস নেওয়ার অনুশীলন এবং নিয়মিত
শরীরচর্চার মতো বিশ্রামমূলক কাজে অংশ নিলে মানসিক চাপ কমে এবং ত্বক পরিস্কার
থাকতে সাহায্য করে।
পর্যাপ্ত পানি পান করাঃ পর্যাপ্ত পানি
পান করলে শরীরের ক্ষতিকর টক্সিন বের হয়ে যায়, যা লোমকূপ বন্ধ হয়ে ব্রন হওয়ার
ঝুঁকি কমায়। শরীরে সঠিক মাত্রায় পানি থাকলে তা ত্বকের সুরক্ষা স্তরকে মজবুত রাখে,
এছাড়াও এটি ত্বকের শুস্কতা ও চুলকানি প্রতিরোধ করে এবং অতিরিক্ত তেল উৎপাদন
নিয়ন্ত্রনে রাখে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করলে ত্বকের স্বচ্ছতা
বৃদ্ধি পায় এবং ত্বকের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভালো হয়।
পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করাঃ ঘুমের অভাব
হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে, যা অতিরিক্ত তেল উৎপাদন ও প্রদাহ সৃষ্টি করে
এবং ব্রনের কারন হতে পারে। ঘুমের সময় ত্বকের পুননির্মান ও মেরামতের কাজ চলতে
থাকে, তাই স্বাস্থ্যকর ত্বকের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।
প্রতিদিন ৭-৯ ঘণ্টা ভালো ঘুম নিশ্চিত করলে ত্বকের নিরাময় প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত
হয়, ব্রন কমে এবং ত্বকের টেক্সচার উন্নত হয়।
ত্বকের যত্নের প্রাকৃতিক পদ্ধতিগুলো
দৈনন্দিন জীবনে একটি মৃদু এবং প্রাকৃতিক ত্বকের যত্নের রুটিন মেনে চললে ব্রণ
প্রতিরোধ ও হ্রাস করা সম্ভব। প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি অথবা মৃদু কেমিক্যাল
যুক্ত পণ্য ব্যবহার করলে ত্বকের জ্বালাপোড়া কমে এবং অতিরিক্ত তেল উৎপাদন বন্ধ হয়।
পরিস্কার ও স্বাস্থ্যকর ত্বক পাওয়ার জন্য আমাদের নিয়মিত ও কোমল যত্ন নেওয়া
জরুরি।
মৃদু ক্লেনজিংঃ একটি মৃদু, সালফেট-মুক্ত
ক্লেনজার বা ফেস-ওয়াস দিনে দুবার ব্যবহার করলে অতিরিক্ত তেল ও ময়লা দূর হয় এবং
ত্বকের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা বজায় থাকে। অতিরিক্ত শক্তিশালী ক্লেনজার ত্বকের
প্রাকৃতিক তেল সরিয়ে ফেলে, যার ফলে ত্বকে আরও বেশি তেল উৎপাদিত হয়। একটি মৃদু
ক্লেনজার ত্বক পরিস্কার রাখে কিন্তু তা শুস্ক ত্বক বা জ্বালাপোড়া তৈরি করে
না।
প্রাকৃতিক উপাদানে এক্সফোলিয়েশনঃ ওটমিল
বা মধুর মতো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে এক্স ফোলিয়েশন (প্রাকৃতিক উপাদানগুলো ত্বকে
ছোট, বৃত্তাকার গতিতে আলতো করে লাগান। প্রায় 30 সেকেন্ড ধরে এটি করুন, এবং তারপর
হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন) করলে ত্বকের মৃত কোষ দূর হয় এবং লোমকূপ
পরিস্কার থাকে। এসব উপাদান রাসায়নিক লোশনের মতো ত্বকের উপর কঠোর না হবার কারনে
এদের দ্বারা ত্বকের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে অতিরিক্ত এক্সফোলিয়েশন
ত্বকের সুরক্ষা স্তর ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তাই এটি সপ্তাহে দু-তিনবারের বেশি
করা উচিৎ হবে না।
প্রাকৃতিক ফেস মাস্ক ব্যবহারঃ
- হলুদের মাস্ক - হলুদে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুন রয়েছে, যা ত্বকের ব্রন জনিত লালচে ভাব কমায় এবং ব্রন দূর করতে সাহায্য করে। হলুদ গুঁড়ার সাথে মধু এবং দই মিশিয়ে একটি প্রশান্তিদায়ক মাস্ক তৈরি করা যায়। নিয়মিত ত্বকে লাগালে এই মাস্ক ব্রন জনিত প্রদাহ কমায় এবং ত্বকের স্কিন টোন সমান করতে সহায়তা করে।
- মধু ও দারুচিনি মাস্ক- মধু ও দারুচিনিতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য থাকার কারনে সেগুলো ত্ত্বকে ব্রনের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করে থাকে। মধু ত্বককে আর্দ্র ও কোমল রাখে, আর দারুচিনি এতে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী শক্তি যোগ করে। এই দুই উপাদান একসঙ্গে ব্যবহার করলে ব্রন হ্রাস পেতে পারে এবং ত্বক পরিস্কার ও মসৃন হয়।
- ক্লে মাস্ক- বেন্টোনাইট বা কাওলিন ক্লে মাস্ক ত্বক থেকে অতিরিক্ত তেল শোষন করে ত্বককে ডিটক্সিফাই করে। এই প্রাকৃতিক ক্লে ত্বকের গভীর থেকে ময়লা টেনে বের করে, যার ফলে ভবিষ্যতে ব্রন হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এটি সপ্তাহে এক থেকে দুইবার ব্যবহার করলে ত্বকের তেল নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভভ হয়, আবার এটি ত্বককে অতিরিক্ত শুস্ক হবার হাত থেকে রক্ষা করে।
ক্ষতিকর রাসায়নিক পরিহার করাঃ বাজারে অনেক প্রচলিত কসমেটিক পণ্য কঠোর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি করা
হয়ে থাকে যা ব্রন প্রবন ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সালফেট, অ্যালকোহল এবং
কৃত্তিম সুগন্ধির মত উপাদান ত্বকের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা নষ্ট করে এবং ত্বকে
জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে। নন-কমেডোজেনিক, কৃত্তিম সুগন্ধ এবং অ্যালকোহল
মুক্ত পণ্য ব্যবহার করলে ত্বকের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং ব্রনের ঝুঁকি কমে
যায়।
ব্রন নিয়ন্ত্রন করার জন্য প্রাকৃতিক পরিপূরক
কিছু প্রাকৃতিক পরিপূরক হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ব্রনের লক্ষন কমাতে
সাহায্য করতে পারে। এই পরিপূরকগুলি ত্বকের তেল নিয়ন্ত্রন, প্রদাহ হ্রাস এবং
অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করতে কাজ করতে পারে। দৈনন্দিন রুটিনে এগুলো গ্রহন
করলে ত্বক আরও পরিস্কার ও সুস্থ্য হতে পারে।
জিংকঃ জিংক আমাদের শরীরের জন্য একটি
প্রয়োজণীয় খনিজ যা ত্বকের তেল উৎপাদন নিয়ন্ত্রন করে এবং প্রদাহ কমাতে সহায়তা
করে। এটি সেবামের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে, যার ফলে লোমকূপ বন্ধ হয়ে ব্রন হওয়ার
ঝুঁকি থেকে আমাদের রক্ষা করে। জিংক সাপ্লিমেন্ট গ্রহন করা অথবা কুমড়ার বীজ ও
মসুর ডালের মতো জিংক সমৃদ্ধ খাবার খেলে ব্রন-প্রবন ত্বকের উপকার হতে
পারে।
ভিটামিন এ ও ইঃ ভিটামিন এ এবং ভিটামিন
ই উভয়ই ত্বকের পুনর্গঠন, সুরক্ষা ও সামগ্রিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন এ কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করে ও লোমকূপ বন্ধ হওয়া রোধ
করে, আর ভিটামিন ই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে ও ত্বককে ক্ষতির হাত থেকে
রক্ষা করে। গাজর ও মিষ্টি আলুর মতো ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার এবং বাদাম ও
সূর্যমুখীর বীজের মতো ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার খেলে ত্বক সুস্থ ও উজ্জ্বল
থাকতে পারে।
প্রোবায়োটিকসঃ প্রোবায়োটিকস্ অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে; গবেষনায় দেখা গেছে
অন্ত্রের অবস্থা ত্বকের স্বাস্থ্য ও ব্রন নিয়ন্ত্রনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যহীনতা ত্বকে বাড়তি প্রদাহের সৃষ্টি করে ব্রন
বাড়ানোর কারন হতে পারে। দই, ঘোল, মাঠার মতো প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার খেলে
অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য প্রতিষ্টিত হয় এবং এর ফলে ত্বকে ব্রনের প্রকোপ
কমে যায়।
শেষ কথা
সবশেষে বলা যায়, ব্রন থেকে মুক্তি পাবার প্রাকৃতিক উপায়গুলো ব্রন নিয়ন্ত্রনের
জন্য রাসায়নিক চিকিৎসার কঠোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত একটি কোমল এবং
কার্যকর উপায় প্রদান করে। টি ট্রি অয়েল, অ্যালোভেরা এবং মধুর মত উপাদানগুলি
প্রদাহ কমাতে এবং ব্যাকটেরিয়া দমন করতে সাহায্য করে, এর পাশাপাশি এরা ত্বকের
সুস্থতাও বজায় রাখে।
তবে, ব্রন দূর করার জন্য প্রাকৃতিক উপায়গুলোর ফলাফল ব্যাক্তির ত্বকের ধরন এবং
ব্রনের তীব্রতার উপর নির্ভর করতে পারে। সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য,
প্রাকৃতিক প্রতিকারগুলোকে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, যথাযথ ত্বকের যত্ন এবং
প্রয়োজনে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শের সাথে মিলিয়ে ব্যবহার করা উচিৎ।
আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url