বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে মৃতদেহ সৎকার করার ৭টি আজব পদ্ধতি
মৃতদেহ সৎকারের প্রথা পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, যা জীবন, মৃত্যু এবং পরলোক সম্পর্কে তাঁদের বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে। যদিও বিশ্বের বেশিরভাগ সমাজ ও সংস্কৃতিতে মৃত ব্যক্তিদের আগুনে পোড়ানো বা কবরে সমাহিত করা হয়ে থাকে, তারপরেও কিছু কিছু সংস্কৃতিতে অদ্ভুত এবং কখন কখনও আশ্চর্যজনক রীতির মাধ্যমে মৃতদেহের সৎকার করা হয়ে থাকে।
তিব্বতের আকাশ সমাধি থেকে শুরু করে মাদাগাসকারের বিচিত্র পূর্বপুরুষ উৎসব পর্যন্ত এই প্রথাগুলি গভীরভাবে আধ্যাত্মিক, প্রতীকী বা কখনও কখনও উৎযাপনমূলক হতে পারে। এই আর্টিকেলে বর্নিত সাতটি আজব শেষকৃত্য প্রথা অনুসন্ধান করে আমরা বুঝতে পারব বিভিন্ন সংস্কৃতি কিভাবে জীবন মৃত্যুর মতো সার্বজনীন অভিজ্ঞতাকে মোকাবেলা করে।
সূচিপত্রঃ বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে মৃতদেহ সৎকার করার ৭টি আজব পদ্ধতি
তিব্বতীয় আকাশ সমাধি
আকাশ সমাধি তিব্বতের একটি ঐতিহ্যবাহী শেষকৃত্যের আয়োজন যেখানে মৃতদেহকে
পাহাড়ের চুড়ায় রেখে দেওয়া হয় যাতে করা শকুনেরা তা খেতে পারে। এই প্রথা বৌদ্ধ
ধর্মের কিছু বিশ্বাসের (যেমন জগতে বস্তুর ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতি এবং জীবনের
প্রাকৃতিক চক্র) সাথে গভীরভাবে জড়িত। এভাবে নিজের দেহকে প্রকৃতির কাছে বিলিয়ে
দেবার মাধ্যমে এবং এর ফলে ঐ মৃতদেহ খেয়ে অন্যান্য পশুপাখির পুষ্টি যুগীয়ে মৃত
ব্যাক্তি একটি চূড়ান্ত দান করেন।
এই প্রথাটি তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের দেহের উপর মায়া ত্যাগ করার শিক্ষার সাথে মিলে
যায়। তারা বিশ্বাস করে যে মৃত্যুর সময় আত্মা চিরকালের মত দেহ ত্যাগ করে চলে যায়,
যার ফলে ব্যাক্তি মারা গেলে তার দেহের আর কোন প্রকৃত মুল্য থাকে না। মৃতদেহকে কবর
না দিয়ে এভাবে প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া বিশ্বাসীদের মনে জীবনের
ক্ষণস্থায়ীত্বের ধারনাকে আরও শক্তিসালী করে তোলে।
তিব্বতের কঠোর, শুস্ক পরিবেশের কারনে স্থানীয় আদিবাসীদের কাছে মৃতদেহের আকাশ
সমাধি একটি বাস্তবসম্মত সমাধান ঘিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ভৌগলিকভাবে তিব্বতের
মাটি পাথরের মত শক্ত হবার কারনে কবর খোঁড়া খুব কঠিন, আবার মৃতদেহকে পোড়ানোর জন্য
প্রয়োজনীয় কাঠের অভাব থাকায় দাহক্রিয়া খুব বেশি প্রচলিত নয়। সুতরাং মৃতদেহকে
শকুনদের খেতে দেবার এই প্রথা দেহ নিস্পত্তির একটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি হিসেবে
ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান রোগ্যাপা (Rogyapas), যাদেরকে দেহ ভাঙ্গানোর
কারিগরও বলা হয়, নামের বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ব্যাক্তিরা সম্পন্ন করে থাকে।
মৃতদেহকে যাতে শকুনেরা সহজে খেতে পারে সেজন্যে তারা চাকু এবং কুড়াল দিয়ে লাশকে
কয়েক টুকরো করে দেয়। শকুনেরা দেহের সব মাংস খেয়ে নেবার পর যেসব হাড় পড়ে থাকে
সেগুলো সংগ্রহ করে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুড়ো করা হয়; আটা বা ময়দার সাথে এই হাড়ের
গুড়ো এবং পানি মিশিয়ে ছোট ছোট বলের মত করে তা কাক অথবা চিল জাতীয় পাখিদের খাওয়ানো
হয়।
তিব্বতীয় সমাজে এই প্রক্রিয়াটিকে ভয়ঙ্কর বলে বিবেচনা করা হয় না। বরং তাদের সমাজে
একে একটি পবিত্র দ্বায়িত্ব হিসাবেই দেখা হয়ে থাকে, যার ফলে মৃত ব্যাক্তির আত্মা
সফলভাবে পরকালে চলে যেতে সক্ষম হয়।
তিব্বতীয়দের জন্য এই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে শকুনদের উপস্থিতি থাকাকে অপরিহার্য ধরা
হয়; তাদের উপস্থিতি মৃত ব্যাক্তির দেহদানকে গ্রহন করার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়ে
থাকে। তিব্বতীয় সংস্কৃতিতে, শকুনেরা লাশকে পুরোপুরি খেয়ে ফেললে তা মৃত ব্যাক্তির
জীবিত থাকা অবস্থায় ভালো কাজগুলোর স্বীকৃতি ও এর ফলাফল স্বরূপ তার আত্মার মুক্তি
নির্দেশ করে। এই প্রথাটি শেষ পর্যন্ত সমবেদনা, পারস্পরিক সংযোগ এবং জীবনের
ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতিকে মেনে নেওয়ার মতো মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে।
মৃতদেহের ছাইভস্মকে পুঁতিতে পরিনত করা
মৃতদের কবর দেবার জায়গা ক্রমেই সীমিত হয়ে আসার কারনে দক্ষিণ কোরিয়ায় শবদাহন
মৃতদেহ সামলানোর প্রধান পদ্ধতি হয়ে উঠছে। নগরায়নের হার বেড়ে যাওয়া এবং এর ফলে
কবর দেওয়ার স্থান কমে যাওয়া এবং ব্যায়বহুল হয়ে ওঠার কারনে দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক
পরিবারই ঐতিহ্যবাহী কবর দেওয়ার পরিবর্তে দাহপ্রক্রিয়া বেছে নিচ্ছে। এই পরিবর্তন
বৈষয়িক এবং মৃত্যুকে স্মরন করার প্রতি সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনকেও
প্রতিফলিত করে।
কিছু পরিবার এই দাহনক্রিয়াকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে তাদের প্রিয়জনের অস্থি
ভস্মকে ছোট, রঙিন পুঁতিতে রূপান্তরিত করে। এই পুঁতিগুলোকে চকচকে রত্নের মত
দেখায়; একটি বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে যন্ত্রের সাহায্যে মৃতের ছাই ভস্মকে
উচ্চচাপে সংকুচিত করে এগুলো তৈরি করা হয়ে থাকে। ছাইকে বিশেষ জার বা কলসিতে
সংরক্ষন করা অথবা প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দেবার পরিবর্তে, পরিবারগুলো এই
স্মৃতিচিহ্নগুলো নিজেদের বাড়িতে রেখে তাদের প্রিয়জনদের সাথে মানসিকভাবে সংযুক্ত
থাকে।
এই পদ্ধতিটি আরও ব্যাক্তিগত ও রুচিসম্মতভাবে মৃত ব্যাক্তিদের সম্মান জানানোর
একটি উপায় তৈরি করে দেয়। মৃতদেহের ছাইভস্ম রাখার সাধারন পাত্রের মত এটি ঘরের
কোনায় লুকিয়ে না রেখে এই পুঁতিগুলোকে সুন্দরভাবে প্রদর্শন করা যায় অথবা
শৈল্পিকভাবে ডিজাইন করা পাত্রে সংরক্ষন করা যায়। এর ফলে মৃতব্যাক্তির পরিবার
কোন নির্দিষ্ট সমাধিস্থলে না গিয়েই তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রিয়জনদের স্মরন করার
সুযোগ পায়।
বাস্তবিক কারণগুলোর পাশাপাশি, কোরিয়ান সংস্কৃতির কিছু দিকও এই প্রবনতাকে
উৎসাহিত করে আসছে। কোরিয়ান সমাজে পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখাকে
গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়ে থাকে; মৃত গুরুজনদের ছাইভস্ম দিয়ে বানানো পুঁতিগুলো এই
ঐতিহ্যকে আধুনিক উপায়ে ধরে রাখার সুযোগ করে দেয়। আধুনিক জীবন যাত্রা ও
স্থান সংকটের সাথে সংগতি বজায় রেখে এগুলো মৃতব্যাক্তির প্রিয়জনদের জন্য একটি
দৃশ্যমান স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কাজ করে।
দিনে দিনে যতই শবদাহন এবং অন্যান্য শেষকৃত্য অনুষ্ঠানগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে,
মৃত ব্যাক্তির স্মৃতি মনে রাখার জন্য পুঁতির ব্যবহারও ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। এই
নতুন পদ্ধতি দক্ষিণ কোরিয়ান সমাজের আধুনিকতাকে গ্রহন করা এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী
পূর্বপুরুষ পূজার মিশ্রনকে প্রতিফলিত করে। এভাবে পরকালে পাড়ি জমানো স্বজনদের
স্মরনে নতুনত্ব গ্রহনের মাধ্যমে পরিবারগুলো তাদের প্রিয়জনদের সুন্দর এবং অর্থবহ
উপায়ে কাছাকাছি রেখে মানসিক শান্তি লাভ করতে পারে।
ফামাদিহানা-হাড় তোলার উৎসব
আফ্রিকা মহাদেশের মাদাগাস্কার দ্বীপের মালাগাসি জাতির
লোকেরা ফামাদিহানা (Famadihana) বা হাড় তোলার উৎসব নামের এক ধরনের বিচিত্র শেষকৃত্য অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এই রীতিতে
পরিবারের সদস্যরা তাদের পূর্বপুরুষদের দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে এনে নতুন কাপড়
পড়িয়ে উৎসব করে। এটি একটি আনন্দময় অনুষ্ঠান হয়ে থাকে যেখানে মৃতের আত্মীয়
স্বজনেরা সঙ্গীত, নৃত্য এবং পারিবারিক মিলন মেলা আয়োজন করে থাকে।
পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য এবং জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী শুভ সময়ের উপর নির্ভর
করে ফামাদিহানা সাধারনত প্রতি পাঁচ থেকে সাত বছর পর পর হয়ে থাকে। মালাগাসিরা
বিশ্বাস করে যে এই রীতি পালন করার মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের আত্মার সাথে তাদের
সংযোগ দৃড় হয়; তারা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিকে এভাবে সম্মান জানাতে পারে।
এই উৎসব প্রমান করে যে মালাগাসি সমাজের সদস্যরা মৃত্যুর পরেও পরিবার এবং
সমাজের গুরুতওপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে, পরিবারের সদস্যরা সাবধানে পূর্বপুরুষদের দেহাবশেষ কবর
থেকে বের করে নতুন রেশমি কাপড় দিয়ে মুড়ে দেয়; এই কাপড়ে আবার নতুন করে মৃত
ব্যাক্তির নাম লেখা হয় যাতে করে লোকেরা তাদের নাম মনে রাখতে পারে। এরপর তারা
সঙ্গীতের তালে তালে দেহাবশেষ নিয়ে নাচে, গান গায় এবং ভালো খাবার খায় ও মদ পান
করে। এরপর সন্ধ্যা নেমে আসার আগে আগে মৃতদেহের উদ্দেশ্যে আত্মীয় স্বজনেরা
কাবারি (kabary) নামের ঐতিহ্যবাহী ভাষন দিয়ে থাকে; এটি শেষ হলে মৃতদেহকে
সাবধানতার সাথে আবার কবর দেওয়া হয়।
ফামাদিহানা বর্তমানে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর সমালোচনার শিকার হওয়া এবং সমাজে
আধুনিকতার ছোঁয়ায় এর ব্যাপকতা কমে এলেও অনেক মালাগাসি মানুষের কাছে এটি একটি
অমূল্য ঐতিহ্য হিসেবে রয়ে গেছে। তাদের কাছে এই প্রথা পারিবারিক ইতিহাস ও
সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নির্দেশ করে। ফামাদিহানার মাধ্যমে
অতিত ও বর্তমান একটি উজ্জ্বল এবং অর্থবহ উপায়ে একত্রিত হয়।
ঝুলন্ত কফিন
চীন, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়ার অনেক উপজাতিদের মধ্যে ঝুলন্ত কফিন একটি
প্রাচীন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রথা, যেখানে মৃতদেহকে কফিনে ভরে কফিনগুলোকে
উঁচু পাহাড়ের ঢালে রাখা হয় বা পাথরের গায়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। চীনের বো (Bo),
ফিলিপাইনের ইগরোট (Igorot) এবং ইন্দোনেশিয়ার তোরাজা (Toraja) জন গোষ্ঠীর
মধ্যে এই রীতির প্রচলন দেখা যায়। এই রীতি প্রতিটি জনগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন
ভাবে পালন করলেও, এর পেছনের মূল বিশ্বাস একই থাকে।
মৃতদেহ নিয়ে এরকম আজব প্রথার প্রধান কারনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো
মৃতদের উচ্চ স্থানে রাখা তাদের আত্মাকে আধ্যাত্মিক জগতের কাছাকাছি নিয়ে যায়
এমন ধারনায় বিশ্বাস করা। এসব সংস্কৃতিতে পাহাড় ও খাড়া পর্বত চূড়াকে পবিত্র
স্থান হিসেবে দেখা হয়ে থাকে যেখানে মৃতদের আত্মা বিশ্রাম নিতে পারে। মৃতদেহ
উঁচুতে স্থাপন করার মাধ্যমে পরিবারগুলো নিশ্চিত করে যে তাদের পূর্বপুরুষদের
আত্মা সহজেই পরলোকগমন করতে পারবে।
ঝুলন্ত কফিন ব্যবস্থার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মৃতদেহের সুরক্ষা।
মৃতদেহ মাটি থেকে উঁচু স্থানে ঝুলিয়ে রাখার ফলে তাদের দেহাবশেষ শিকারি
প্রাণী, বন্যা এবং মানব হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা পায়। এই সমাধি পদ্ধতি মৃতদেহ
অক্ষত রাখার পাশাপাশি প্রকৃতির সঙ্গে একটি গভীর আধ্যাত্বিক সংযোগও
প্রতিফলিত করে।
অঞ্চল ও সংস্কৃতি ভেদে এই ঝুলন্ত কফিনগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্থানে স্থাপন করা
হয়ে থাকে। কিছু কফিন পাহাড়ের প্রাকৃতিকে ফাটলে রাখা হয়, আবার কোন কোন
কফিনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে কাঠের খুঁটির সাহায্যে পাহাড়ের গায়ে স্থাপন করা হয়।
সময়ের সাথে সাথে এরকম অনেক কফিন এখনো অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে এবং এগুলো সেই
অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে টিকে আছে।
অবশ্য বর্তমানকালে এই প্রথা মেনে কফিন ঝুলিয়ে রাখার প্রবনতা অনেক কমে
এসেছে, তারপরও ঐ এলাকায় বসবাস করা সম্প্রদায়গুলো একে তাদের সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। প্রাচীন রীতিনীতি
সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকায় কিছু ঝুলন্ত কফিনের স্থান আজকাল পর্যটকদের জন্য
আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে। সময় বদলালেও, ঝুলন্ত কফিনের এই ঐতিহ্য পূর্বপুরুষদের
প্রতি শ্রদ্ধা ও আধ্যাত্মিক যাত্রার প্রতীক হিসেবে টিকে আছে।
মৃতদেহের মাংস ভক্ষণ করা (এন্ডোক্যানিবালিজম)
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন এবং দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার পাপুয়া নিউ গিনির কিছু
আদিবাসী গোষ্ঠী ঐতিহাসিকভাবে এন্ডোক্যানিবালিজম এর চর্চা করত,
যেখানে তারা নিজেদের মৃত আত্মীয়দের দেহ ভক্ষণ করত। ব্রাজিলের ওয়ারি'
(Wari') এবং পাপুয়া নিউ গিনির ফোরে (Fore) জনগোষ্ঠী এই ঐতিহ্যের জন্য
বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। এসব জনগোষ্ঠীতে একে মৃতদের সম্মান জানানোর
জন্য একটি পবিত্র রীতি এবং পারিবারিক বন্ধন দৃড় করার উপায় হিসেবে বিবেচনা
করা হতো।
প্রিয়জনদের মাংস খাওয়া এই জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য সহিংসতা নয়, বরং শ্রদ্ধার
প্রতীক ছিল। তারা বিশ্বাস করত যে মৃতদের দেহ ভক্ষন করার মাধ্যমে তারা মৃত
ব্যাক্তির আত্মাকে তাদের মাঝে ধারন করে থাকে। তারা বিশ্বাস করত এই রীতি
পালন করার মাধ্যমে সমাজের জীবিত সদস্য ও তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে একটি
শক্তিশালী সংযোগ বজায় থাকে; এর মাধ্যমে মৃত স্বজনেরাও যাতে সমাজের অংশ
হতে পারে তা নিশ্চিত করা যায়।
এছাড়াও এসব সম্প্রদায়ের কাছে এন্ডোক্যানিবালিজম এক ধরনের শোক প্রকাশ
এবং মৃত ব্যাক্তিকে শ্রদ্ধা জানানোরও এক ধরনের উপায় হিসেবে বিবেচিত হত।
মৃতদের মাটিতে পচে যাওয়ার জন্য ফেলে না রেখে, বা বন্য প্রানিদের খাবার
হওয়া থেকে মৃতদেহকে বাঁচানোর মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির পরিবারে এটিকে তাদের
সদ্যমৃত স্বজনদের প্রতি ভালোবাসার চূড়ান্ত প্রকাশ হিসেবে
দেখত।
পাপুয়া নিউ গিনির ফোরে (Fore) জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই প্রথার
কারনে কুরু (Kuru) নামের
একধরনের প্রিয়ন (Prion) জনিত স্নায়ুবিক রোগের
বিস্তার ঘটেছিল। মৃত ব্যাক্তির মস্তিস্কের সংক্রমিত অংশ খাওয়ার কারনে
তাদের মাঝে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে মারাত্বক এবং প্রাণঘাতী স্বাস্থ্য সমস্যা
(যেমন হাঁটতে অসুবিধা হওয়া, অনিচ্ছাকৃত নড়াচড়া করা, আচরণগত এবং
মেজাজের পরিবর্তন, ডিমেনশিয়া এবং খেতে অসুবিধা হওয়া এবং এর কারনে
অপুষ্টিতে ভোগা) দেখা দেওয়ার কারনে শেষ পর্যন্ত এই প্রথার পতন ঘটে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এই রোগের কারন বুঝতে পারার কারনে অনেক
সম্প্রদায় নিজেদের সুরক্ষার জন্য এই রীতিকে ত্যাগ করে।
যদিও এন্ডোক্যানিবালিজম এখন আর তেমন একটা প্রচলিত নেই, তারপরও এটি
সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়গুলোর ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে রয়ে
গেছে। এই প্রথা জীবন, মৃত্যু এবং অতীত ও বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সংযোগ
সম্পর্কে তাদের গভীর বিশ্বাসকেই প্রতিফলিত করে। এই ঐতিহ্য বিতর্কিত হলেও
এটি বিশ্বের বিভিন্ন সমাজে কীভাবে মৃতদের সম্মান জানানো হয় এবং তাদের
স্মৃতি মনে রাখা হয় তার একটি বৈচিত্রময় উদাহরন হিসেবে রয়ে যাবে।
বাহারি কফিন
আফ্রিকা মহাদেশের ঘানার গা (Ga) জনগোষ্ঠীতে মৃতদের
শেষকৃত্য একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এবং জাঁকজমকের সাথে পালন করা হয়ে
থাকে। এই অনুষ্ঠানের একটি অনন্য দিক হল মৃত ব্যক্তিকে কল্পনাপ্রুসূত
বাহারি কফিনে দাফন করা, যা মৃত ব্যাক্তির পেশা, শখ বা ব্যাক্তিত্বের
প্রতিচ্ছবি হিসেবে তৈরি করা হয়ে থাকে। এই কফিনগুলো বিমান, মাছ, জুতো,
এমনকি কোকা-কোলা বোতলের আকৃতিতেও তৈরি করা হয়; যার ফলে প্রতিটি
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াই মৃত ব্যাক্তির জীবনকে স্মরন করার একটি উৎসবে পরিনত
হয়।
এই প্রথাটি গা জনগোষ্ঠীর পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস থেকে উদ্ভুত হয়েছে।
প্রিয়জনদের এমন বাহারি কফিনে কবর দেবার মাধ্যমে তাদের পরিবার নিশ্চিত
করে যে তাঁদের আত্মা মৃত্যু পরবর্তী জগতেও তাঁদের ব্যাক্তিত্ব ও পরিচয়
বহন করবে। তারা বিশ্বাস করে যে মৃত্যু জীবনের শেষ নয়, বরং এই প্রথার
মাধ্যমে তারা মৃতের আত্মাকে আরেকটি পর্যায়ে উত্তরনের প্রতীক হিসেবে
দেখে থাকে।
এই কফিনগুলো তৈরি করতে স্থানীয় শিল্পীদের সেই রকমের দক্ষতা এবং
সৃজনশীলতার প্রয়োজন হয়। দক্ষ কাঠমিস্ত্রিরা প্রতিটি কফিনকে নিখুঁতভাবে
এমন করে খোদাই ও রং করে, যাতে সেগুলো বাস্তব বস্তুগুলোর সজীব প্রতিরূপ
হয়ে ওঠে। শিল্পীরা পরিবারগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন যাতে চূড়ান্ত
নকশাটি সত্যিকার অর্থেই মৃত ব্যাক্তির ব্যাক্তিত্বের প্রতিফলন
ঘটায়।
এই বাহারি কফিনগুলো ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে এবং এর
ফলে বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘর ও শিল্পগ্যালারিতে এগুলো
প্রদর্শিত হয়ে থাকে। পর্যটক ও শিল্পপ্রেমীরা প্রায়ই শুধুমাত্র এই
বিস্ময়কর সৃষ্টিগুলো সচক্ষে দেখার জন্যই ঘানায় ভ্রমন করেন।
এই কফিনগুলো শেষকৃত্য অনুষ্ঠানকে দেখতে অনেক আকর্ষনীয় করে তুললেও,
এগুলো গা সম্প্রদায়ের জন্য গভীর আবেগপূর্ণ ও
আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বহন করে। তাঁদের সমাজে এই বাহারি কফিনগুলো
মৃতব্যাক্তির পরিবারের জন্য তাঁদের প্রিয়জনদের সম্মান জানানোর একটি
অর্থবহ ও স্মরনীয় উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত এই প্রথা
গা জনগোষ্ঠীর এরকম বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে যে জীবনকে যে কোন রূপে,
এমনকি মৃত্যুতেও, উৎযাপন করা যায়।
পার্সি (জরথুস্ট্র) ধর্মের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
ইরানের পার্সি ধর্মে মৃতদেহের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান বেশ অন্য ধরনের হয়ে
থাকে এবং এই আচারগুলো তাঁদের ধর্মের শুদ্ধতা এবং পরকাল নিয়ে
বিশ্বাসের সাথে গভীরভাবে জড়িত। প্রাচীন পারস্যে উদ্ভূত এই ধর্মে
মাটি, পানি, আগুন এবং বাতাসকে পবিত্র বলে মনে করা হয় এবং এগুলো দূষিত
হয় এমন কাজ থেকে তারা নিজেদের বিরত রাখে। এই কারনে, ঐতিহ্যবাহী
জরথুস্ট্র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় মৃতদেহকে দাহ অথবা কবর দেওয়ার পদ্ধতি
অনুসরন করা হয় না।
দেহকে কবর দেবার পরিবর্তে,
পার্সিরা এক্সকার্নেশন (Excarnation) নামক একটি
পদ্ধতি অনুসরন করে থাকে যেখানে মৃতদেহকে টাওয়ার অফ সাইলেন্স (Tower of Silence) অথবা ডাকমা (Dakhma) নামের এক
জায়গায় গিয়ে রেখে দেওয়া হয়। এই জায়গাগুলো দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা
বৃত্তাকার ছাদ খোলা জায়গা যেখানে মৃতদেহকে শকুন এবং অন্যান্য মাংসাশী
পাখির জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পবিত্র
উপাদানগুলোকে দূষিত না করেই মৃতদেহ পুনরায় প্রকৃতির অংশ হয়ে
যায়।
বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত পুরোহিতদের মাধ্যমে মৃতদেহের শুদ্ধিকরন
প্রক্রিয়ার দিয়ে মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রক্রিয়া শুরু হয়। মৃত
ব্যাক্তিকে সাদা কাপড়ে মোড়ানো হয় এবং বাহকদের দ্বারা ডাকমাতে নিয়ে
যাওয়া হয়; এই বাহকদের আবার পরে শুদ্ধিকরন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে
হয়। পার্সি ধর্মে মৃতদেহের সংস্পর্শকে আত্মার জন্য অশুদ্ধ বলে মনে
করা হয় বলে মৃত ব্যাক্তির পরিবারের সদস্যরা এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়
না।
শকুন এবং অন্যান্য প্রাণীরা মৃতদেহের মাংস খেয়ে ফেলার পরে হাড়গুলো
ডাকমার কেন্দ্রে অবস্থিত একটি গর্ত বা কুয়ায় রেখে দেওয়া হয়, যেখানে
সেগুলি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে থাকে। মৃত ব্যাক্তির আত্মাকে পরকালের
পথে পরিচালিত করার জন্য সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ধর্মীয় প্রার্থনা ও
আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে।
বর্তমানে নগরায়ন ও আইনি সীমাবদ্ধতার কারনে অনেকে পার্সি মৃতদেহ
সৎকারের জন্য বিকল্প পদ্ধতি (যেমন মৃতদেহ দাহ করা অথবা কংক্রিটের
আস্তরণ দেয়া কবরে মৃতদেহকে সমাহিত করা ) গ্রহন করে আসছে। এই
পদ্ধতিগুলো মৃতদেহকে সরাসরি মাটির সংস্পর্শে আসতে বাধা দিয়ে তাঁদের
ধর্মীয় বিশুদ্ধতা রক্ষার নীতি মেনে চলে। তবে এখনও ভারত ও ইরানের কিছু
অঞ্চলের পার্সি সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাঁদের প্রাচীন প্রথা সংরক্ষনের
জন্য ঐতিহ্যবাহী ডাকমা ব্যবহার করে থাকে।
শেষ কথা
মৃতদেহের শেষকৃত্য প্রথা আমাদের বিভিন্ন সংস্কৃতির মূল্যবোধ ও
বিশ্বাসকে বোঝার একটি অনন্য সুযোগ তৈরি করে দেয়। এই আর্টিকেলে
বর্নিত মৃতদেহ সৎকারের প্রথাগুলো আমাদের অনেকের কাছে অদ্ভুত বা
অবাক করে দেবার মত মনে হলেও, যারা এগুলো অনুসরন করে তাদের জন্য এটি
গভীর অর্থ বহন করে এবং জীবন, মৃত্যু ও পূর্বপুরুষদের নিয়ে তাদের
বিশ্বাসগুলোর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।
এছাড়াও, এই সাতটি আজব শেষকৃত্য প্রথা নিয়ে আলোচনা করে আমরা বিভিন্ন
সমাজ ও সংস্কৃতিতে মানুষ কিভাবে মৃতদের সম্মান জানায় তার বৈচিত্রময়
উপায়গুলো সম্পর্কে জানতে পারি। এই উপায়গুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়
যে সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতি আমাদের প্রিয়জনদের চিরতরে বিদায়
জানানোর ঐতিহ্যকেও নানাভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।
আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url