নিদ্রাহীন রাতগুলি ভালভাবে কাটানোর কিছু উপায়

 

আমাদের ব্যাক্তিগত জীবনের নানামুখী চাপ, বিভিন্ন কারনে ঘুম না আসা বা অনিয়মিত ঘুমের কারনে নিদ্রাহীন রাতগুলি হতাশাজনক হতে পারে। এই সময়টিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে ঘুমের অভাবজনিত নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা কমানো সম্ভব।

নিদ্রাহীন-রাতগুলি-ভালভাবে-কাটানোর-কিছু-উপায়

মনকে শান্তি দেয় এমন কাজে মনযোগ দেওয়া অথবা সংসারের ছোট কাজগুলো সম্পন্ন করা ঘুমহীন রাতকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে সহায়তা করতে পারে। এই আর্টিকেলে বর্নিত কৌশলগুলো অবলম্বন করলে বিছানায় অহেতুক এপাশ অপাশ করার বদলে আপনিও এই সময়টিকে কার্যকর বা প্রশান্তিদায়ক মুহুর্তে পরিনত করতে পারবেন।  

সূচিপত্রঃ নিদ্রাহীন রাতগুলি ভালভাবে কাটানোর কিছু উপায়

কি কারনে রাতে ঘুম হয় না সেই কারণগুলো বোঝা

নির্ঘুম রাতগুলি কিভাবে ভালোভাবে কাটানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করার আগে, রাতে ঘুম না আসার সাধারন কারনগুলি আমাদের জন্য বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। এই কারনগুলো একবার বোঝা সম্ভব হলে একজন ব্যাক্তি তার সমস্যাগুলো বুঝে তার ঘুমের অভ্যাসের উন্নতি করার জন্য পদক্ষেপ নিতে পারেন অথবা জেগে থাকা সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারেন। এই কারণগুলো হলোঃ

চাপ ও উদ্বেগঃ পেশাগত কাজ, পারিবারিক সম্পর্ক বা ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা ব্যাক্তির পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী চাপ মস্তিস্ককে অনেক সময় ধরে সক্রিয় রাখে, যার ফলে রাতে মন শান্ত হওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। সময়ের সাথে সাথে, এই অতিরিক্ত সজাগ থাকার অভ্যাস ক্রমাগত ঘুমের অভাবের কারন হতে পারে। 

ক্যাফেইনযুক্ত উদ্দীপক গ্রহন করাঃ দিনের অনেক দেরিতে ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় গ্রহন ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। চা, কফি এবং এনার্জি ড্রিংকের মতো উদ্দীপকগুলি আমাদের মস্তিস্কের সজাগ থাকার সময়কে বাড়িয়ে দেয় এবং স্বাভাবিক ঘুম আসার সময়কে বিলম্বিত করে। এমনকি রাতে সামান্য পরিমান ক্যাফেইন গ্রহন করাও শরীরের স্বাভাবিক ঘুমের চক্রকে ব্যাহত করতে পারে। 

ইলেকট্রনিক ডিভাইসঃ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের (যেমন স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার ও টেলিভিশন) স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো আমাদের মস্তিস্কে মেলাটোনিন উৎপাদন কমিয়ে দেয়, যার ফলে রাতে আমাদের রাতে ঘুমাতে অসুবিধা হয়। বিশেষ করে ঘুমের আগে দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রিনের সামনে কাটানো মস্তিস্ককে জাগিয়ে রাখে। রাতে স্ক্রিনের ব্যবহার সীমিত করলে ঘুমের গুনমান উন্নত হতে পারে। 

অনিয়মিত ঘুমের ধরনঃ নাইট শিফটের কাজ বা ভ্রমনের কারনে দেহের জৈবিক ঘড়ির ব্যাঘাত ঘটলে ঘুম নাও আসতে পারে। অনিয়মিত ঘুমের সময়সূচী শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়িকে বিভ্রান্ত করে, যার ফলে ঘুম আসা এবং ঘুমভাব বজায় রাখতে সমস্যা হয়। নিয়মিত ঘুমের রুটিন অনুসরন করলে ঘুমের ধরন নিয়ন্ত্রন করা সহজ হয়ে ওঠে। 

চিকিৎসাগত অবস্থার প্রভাবঃ ক্রমাগত অনিদ্রা, স্লিপ অ্যাপনিয়া এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো রাতে ঘুম না আসার অন্যতম কারন হতে পারে। এছাড়াও দীর্ঘস্থায়ী ব্যাথা, শ্বাস- প্রশ্বাসের সমস্যা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলোও আমাদের দেহ ও মনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ঘুমের সমস্যার জন্য অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যজনিত কারণগুলো চিহ্নিত করতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।  


নিদ্রাহীন রাতগুলি কাটানোর কিছু কার্যকর উপায়

আপনি যদি রাতে ঘুমাতে না পারেন, যদি আপনি জেগে থাকেন, তাহলে নিচে বর্নিত উপায়গুলো অবলম্বন করে আপনি শুধু হতাশা কমানোই নয় বরং ভালো কিছু সম্পন্ন করার অনুভূতি অর্জন করবেন। এরকম কিছু কার্যকর উপায় হলোঃ

বই পড়া

বই পড়া নিদ্রাহীন রাতগুলি কার্যকরভাবে কাটানোর একটি চমৎকার উপায় হতে পারে। এটি মনের অস্থিরতা থেকে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে যায় এবং মস্তিস্ককে অর্থবহ কাজে যুক্ত রাখে। রাতে ঘুমের ধরন আরও ব্যাহত না করতে কাগজের বই অথবা ব্যাকগ্রাউণ্ডে উষ্ণ আলো সেট কর‍া যায় এমন ই-রিডার ব্যাবহার করা ভালো। 

বই পড়া আপনাকে নতুন ধারনা ও তথ্যের সাথে পরিচিত হবার পাশাপাশি এটি আপনার জ্ঞান ও শব্দভান্ডার উন্নত করতে সাহায্য করে। নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস বিভিন্ন জিনিসকে বোঝার ক্ষমতা বাড়ায় এবং মানসিক দক্ষতাকে শক্তিশালী করে। এর ফলে ব্যাক্তির সৃজনশীল প্রবনতাগুলো বিকাশীত হয় এবং তাদের সমালোচামূলক চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতাকেও উৎসাহিত করে। 

বই পড়া মনকে একটি প্রশান্ত বিকল্পের মধ্যে ব্যাস্ত রেখে আমাদের মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। গবেষনায় দেখা গেছে, একটি আকর্ষনীয় বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকা হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক রাখতে এবং মনকে শিথিল করতে পারে। এই প্রশান্তিদায়ক প্রভাব আমাদেরকে ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিতে সহায়ক হয়। 

এছাড়াও, বই পড়া আমাদের বিভিন্ন দৈনন্দিন দুশ্চিন্তা থেকে মানসিক মুক্তি দেয় এবং আমদেরকে বইয়ের মধ্যকার জগতে নিজেদের হারিয়ে যেতে সাহায্য করে। আকর্ষণীয় গল্প বা তথ্যপূর্ণ লেখা আমাদের মনকে চাপমুক্ত করে তোলে। এই মানসিক অবকাশ আমাদেরকে আরও শান্ত এবং সতেজ অনুভূতি অর্জনে সহায়তা করতে পারে। 


ডায়েরি লেখা এবং আত্মবিশ্লেষন

রাতে ঘুম না আসলে ডায়েরি লেখা আপনার আবেগ প্রকাশ, চিন্তা গুছিয়ে নেওয়া এবং লক্ষ্য নির্ধারনের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। ডায়েরি লেখা শুধু চাপ কমাতেই সাহায্য করে না, বরং এটি আপনার জীবনে চলমান বিষয়গুলো আপনাকে স্পষ্টভাবে দেখতে সহায়তা করে থাকে। আপনি ডায়েরিতে যে বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে পারেনঃ 
  • আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লেখা আপনাকে আপনার আবেগকে প্রক্রিয়াকরন করতে এবং কিভাবে আপনি মানসিকভাবে বেড়ে উঠবেন সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গি পেতে সহায়তা করে থাকে। দিনের ঘটনাগুলি নিয়ে চিন্তা করা এবং সেগুলো ডায়েরিতে গুছিয়ে লেখা আপনাকে আপনার চিন্তা ও আচরনের ধরণগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে। এভাবে নিদ্রাহীন রাতগুলিতে নিয়মিত ডায়েরি লেখার অভ্যাস আপনাকে নিজেকে চিনতে এবং নিজের অনুভুতিগুলোর সাথে আপনার গভীর বোঝাপড়া গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। 
  • নির্ঘুম রাতে আপনি ভবিষ্যতে জীবনে কি অর্জন করতে চান তা আপনার ডায়েরিতে স্পষ্ট করে লিখে রাখা আপনাকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর সাফল্য অর্জন করার জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। পরিকল্পনাগুলো ভালো করে গুছিয়ে লিখে রাখলে তা আপনাকে অনুপ্রেরনা যোগাবে এবং এ থেকে আপনি প্রয়োজোনীয় দিকনির্দেশনা পেতে পারবেন। এটি আপনাকে আপনার লক্ষ্যে পৌছানোর অগ্রগতি ট্র্যাক করতে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন আনতে সহায়তা করবে। 
  • রাতে ঘুম না আসলে ডায়েরিতে আপনি আপনার জীবনের কি কি দিক নিয়ে কৃতজ্ঞ আছেন, কত ভালো আছেন সেগুলোর একটি তালিকা লিখে রাখা আপনাকে আপনার জীবনের ইতিবাচক দিকগুলোর প্রতি মনযোগ দিতে সাহায্য করবে। দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট আনন্দ ও অর্জন গুলোর স্বীকৃতি আমাদের মনে সন্তুষ্টির অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এভাবে নির্ঘুম রাতে নিয়মিত কৃতজ্ঞতার চর্চা আমাদের সামগ্রিক মঙ্গলবোধকে উন্নত করতে পারে এবং নেতিবাচক চিন্তাভাবনা কমাতে সহায়ক হয়।  

হালকা ব্যায়াম বা যোগব্যায়ামে যুক্ত হওয়া

ঘুমের আগে অতিরিক্ত ব্যায়াম হিতে বিপরীত হতে পারে, তবে হালকা স্ট্রেচিং, যোগব্যায়াম এবং গভীর শ্বাস প্রশ্বাসের মতো অনুশীলন ঘুমের আগে শরীরকে শিথিল করে তুলতে পারে। এই কাজগুলো নিয়মিত করতে থাকলে এটি আমাদের মস্তিস্ককে শান্ত করতে এবং শরীরকে ধীরে ধীরে ঘুমের জন্য প্রস্তুত করতে সহায়তা করতে পারে। এরকম কিছু হালকা ব্যায়ামের কথা নিচে বর্ননা করা হলোঃ
  • হাত, পা অথবা শরীরের বিভিন্ন অংশগুলো হালকাভাবে টান টান করে কিছুক্ষন ধরে রাখা বা স্ট্রেচিং করা আমাদের শরীরের সারা দিনের জমে থাকা পেশির টান দূর করতে সাহায্য করে। এটি মাংসপেশীতে নমনীয়তা এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে। ঘুমের আগে কিছু সহজ স্ট্রেচিং শরীরকে বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে সহায়ক হতে পারে। 
  • বলবর্ধক যোগব্যায়ামের বিভিন্ন আসনগুলো দেহে গভীর শিথিলতা নিয়ে এনে শারীরিক ও মানসিক চাপ কমানোর উপর জোর দেয়। এই আসনগুলো ধীর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং তার উপর মনযোগ আনানোর মাধ্যমে মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে। ঘুমের আগে এই ধরনের যোগব্যায়াম অনুশীলন করলে ঘুমের গুনমান এবং সামগ্রিক সুস্থতা বৃদ্ধি পেতে পারে। 
  • ধ্যান ও মননশীলতার চর্চা মনকে শান্ত করতে এবং অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা কমাতে সাহায্য করে। গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস বা পরিচালিত ধ্যানের মাধ্যমে বর্তমান মুহূর্তের উপর মনযোগ কেন্দ্রিভূত করলে মানসিক প্রশান্তি আসে। নিয়মিত মননশীলতা চর্চা মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ঘুমের উন্নতি করতে সহায়ক হতে পারে।
নিদ্রাহীন-রাতগুলি-ভালভাবে-কাটানোর-কিছু-উপায়


পডকাস্ট বা অডিওবুক শোনা

পডকাস্ট বা অডিওবুক শোনা রাতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘুম নষ্ট করার একটি চমৎকার বিকল্প হতে পারে। একটি প্রশান্ত কন্ঠস্বর বা আকর্ষনীয় গল্পের উপর মনযোগ দিলে নির্ঘুম রাতগুলো আরও ভালোভাবে কাটিয়েছি এমন মনে হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনি শান্তিময় বা তথ্যবহুল বিষয়বস্তু বেছে নিন, যেমনঃ
  • প্রেরনাদায়ক বা আত্মউন্নয়নমূলক পডকাষ্ট শোনা আপনাদেরকে অনুপ্রেরনা জোগাতে এবং নতুন দৃষ্টিভংগি প্রদান করতে পারে। এই পডকাষ্টগুলোতে প্রায়ই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, ব্যাক্তিগত জীবনে উন্নতির কৌশল এবং সাফল্যের গল্প শেয়ার করা হয়ে থাকে। নিদ্রাহীন রাতে ঘুমহীণ চোখে এই ধরনের বিষয়বস্তু শোনা আপনাদের জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভব গড়ে তুলতে এবং নতুন কিছু করার জন্য আপনাদের অনুপ্রেরনা বাড়াতে সহাহক হতে পারে।  
  • ইতিহাস, বিজ্ঞান বা গল্প বলার উপর ভিত্তি করে অডিওবুক শোনা আমাদের জন্য শিক্ষামূলক এবং চিত্তবিনোদন উভয়ই হতে পারে। আকর্ষনীয় ঐতিহাসিক ঘটনা বা বৈজ্ঞানিক আবিস্কার সম্পর্কে জানা আমাদের মনকে অতিরিক্ত উত্তেজিত না করেই আমাদের কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে পারে। শান্ত কণ্ঠে পাঠ করা হলে গল্প বলার অডিওবুক আমাদের মনে স্বস্তি এবং প্রশান্তির অনুভূতি তৈরি করতে পারে। 
  • বিভিন্ন ধরনের প্রশান্তিদায়ক প্রাকৃতিক শব্দ দুশ্চিন্তা কমিয়ে আমাদের মনকে শান্ত করে সহজে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ইউটিউবে রেকর্ড করা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শব্দ (যেমন ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত, দমকা হাওয়ার শব্দ), সাদা শব্দ (White noise), বা নরম সঙ্গীত শোনা একটি প্রশান্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারে। এই অডিও অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের মনকে শিথিল করে ধীরে ধীরে শরীরকে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত করে।   

ঘর গোছানো ও অপ্রয়োজনীয় জিনিস সরানো

যদি রাতের বেলা আপনার ঘুম না আসে তবে আপনি যে ঘরে থাকেন, সেই ঘরকে হালকা ভাবে গুছিয়ে নেওয়া আপনার মনে একটি সাফল্যের অনুভূতি এনে দিতে পারে। এই কাজগুলো আপনার মনকে অতিরিক্ত উত্তেজিত না করেই সক্রিয় রাখে, যার ফলে আপনি ধীরে ধীরে ঘুমের পরিবেশে ফিরে যেতে পারবেন। এরকম কিছু কাজ হলোঃ
  • প্রথমে একটি ছোট জায়গা যেমন ডেস্ক বা আলমারি থেকে সবকিছু বের করে নিন; বের করা জিনিসগুলো এমনভাবে সাজান যাতে আপনার কি কি জিনিস আছে তা আপনি পরিস্কারভাবে দেখতে পারেন। এসবের মধ্যে যেসব জিনিস আপনার কাছে প্রয়োজনীয় মনে হয়, যেগুলো আপনি নিয়মিত ব্যবহার করেন বা যেসব জিনিস আপনাকে আনন্দ দেয় সেগুলো রেখে বাকিগুলো আলাদা করে রাখুন। এভাবে বাছাই করা হয়ে গেলে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আবার সুন্দরভাবে ডেস্ক বা আলমারিতে রেখে দিন এবং অব্যবহৃত জিনিসগুলো ফেলে দিন বা দান করুন যাতে করে আপনার ঘর পরিস্কার থাকে। 
  • আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য ডিজিটাল ফাইলগুলো বিষয়, অগ্রাধিকার বা প্রকল্প অনুযায়ী ভাগ করে ফোল্ডার বা লেবেল তৈরি করুন। ধাপে ধাপে ইনবক্স বা ডিজিটাল স্টোরেজ ঘেঁটে অপ্রয়োজনীয় ফাইলগুলো মুছে ফেলুন এবং দরকারি ফাইলগুলো সঠিক ফোল্ডারে সরিয়ে নিন। প্রতিসপ্তাহে নির্দিষ্ট একটি সময় ঠিক করে ফাইলগুলো রিভিউ এবং আপডেট করুন যাতে এটি সহজে ব্যবস্থাপনাযোগ্য থাকে। 
  • রাতে আপনি ঘুমাতে না পারলে কয়েক মিনিট সময় নিয়ে আপনার ক্যলেন্ডার দেখে পরের দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি কাজ লেখে ফেলুন। অফিসের কাজ, বিশ্রাম ও বাড়ির কাজের জন্য সময় ভাগ করে রাখুন যাতে করে দিনটি ভারসাম্যপুর্ন হয়। আগেই পরিকল্পনা করে রাখলে সকালে কাজের চাপ কমে যায় এবং সারাদিন আপনার উৎপাদনশীলতা বেড়ে যেতে পারে। 

সৃজনশীল কাজে অংশগ্রহন করা

ঘুমহীন সময় কাটানোর জন্য সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করা একটি ভালো উপায় হতে পারে। সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন মস্তিস্কের জন্য চিকিৎসাগতভাবে উপকারী হতে পারে এবং এটি মানসিক অভিব্যাক্তি প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবেও কাজ করতে পারে। নির্ঘুম রাতে যেসব সৃজনশীল কাজে আপনি নিজেকে ব্যাস্ত রাখতে পারেন তার মধ্যে কয়েকটি নিচে বর্ননা করা হলঃ
  • একটি পেন্সিল তুলে কাগজে মনের মত আঁকা শুরু করাটা আপনাকে অবাক করে দেবার মতো শান্তিদায়ক কাজ হতে পারে। আপনি যতই জটিল চিত্রকর্ম অথবা সাধারন ভাবে কাগজ কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি করেন না কেন, এই সৃজনশীল প্রক্রিয়াটিই আপনাকে মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে। হাতের আঁকা বা ডুডলিং এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে আপনি কোনরকম শব্দ প্রকাশ করা ছাড়াই, অন্য কারও ঘুমের অসুবিধা না ঘটিয়েই, আপনি আপনার ভাবনা ও অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারবেন। 
  • কবিতা বা ছোট গল্প লেখার মাধ্যমে আপনার অনুভূতিগুলোকে শব্দে প্রকাশ করা রাতের বেলায় ঘুম না আসলে আপনার মনকে বিভিন্ন দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাবার একটি শক্তিশালী উপায় হতে পারে। এটি আপানার কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটায় এবং ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতাকে সৃজনশীলভাবে প্রকাশের সুযোগ করে দেয়। এছাড়াও নিয়মিত লেখার অভ্যাস গড়ে তুললে তা আপনাকে বাস্তব জীবনে  আত্মপ্রকাশের দক্ষতা ও যোগাযোগের ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়। 
  • নির্ঘুম রাতে নিজের হাতে কোন কিছু তৈরি করার কাজ আমাদের জন্য গভীরভাবে সন্তোষজনক হতে পারে। রাতের বেলায় কাপড় সেলাই করা থেকে শুরু করে, কাগজ দিয়ে বিভিন্ন জীব জন্তুর মতো ফিগার তৈরি করা অথবা সাধারন কোন হস্তশিল্পে নিজেকে নিয়জিত করা; এসব পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ আপনার মনে প্রশান্তির অনুভূতি এনে দিয়ে রাতে ঘুম পাড়তে সাহায্য করবে। এই সৃজনশীল কাজগুলো আপনাকে আসলেই একটা কিছু করেছেন এমন আত্মতৃপ্তির অনুভূতি এনে দিবে এবং আপনাকে ডিজিটাল দুনিয়া থেকে সাময়িক বিরতি নিতেও সহায়তা করবে। 


নিদ্রাহীন-রাতগুলি-ভালভাবে-কাটানোর-কিছু-উপায়

নিদ্রাহীন রাত কাটানোর শান্তিপূর্ণ উপায়গুলো

আপনি যদি এই আর্টিকেলে এতক্ষন পর্যন্ত বর্ননা করা উৎপাদনশীল কাজগুলোতে অংশগ্রহন করতে না চান, যদি আপনার এসব কাজে নিজেকে ব্যাস্ত রাখার মত মানসিক শক্তি না থাকে, তাহলে শুধু বিশ্রামের দিকেই মনোযোগ দেওয়া আপনার দেহ এবং মনের জন্য উপকারী হতে পারে। নিচে এরকম কিছু প্রশান্তিদায়ক কাজের বর্ননা দেওয়া হলোঃ

গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস ও ধ্যান অনুশীলন

রাতে যদি আপনার ঘুম না আসে তাহলে গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম ও ধ্যান আপনার দেহের প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে (Parasymphathetic nervous system) সক্রিয় করে আপনার দেহে আরামদায়ক শিথিলতা এনে দিতে পারে। এর ফলে আপনি শারীরিক ও মানসিক চাপ থেকে সাময়িকভাবে মুক্তি পাবেন এবং দ্রত ঘুমিয়ে পড়বেন। এরকম কিছু কৌশল হলোঃ
  • প্রথমে ৪ সেকেন্ড শ্বাস নেওয়া, ৭ সেকেন্ড শ্বাস ধরে রাখা এবং পরবর্তি ৮ সেকেণ্ডে ধীরে ধীরে শ্বাস ছেড়ে দেবার অনুশীলনকে ৪-৭-৮ শ্বাস প্রশ্বাস পদ্ধতি বলা হয়ে থাকে। এই ব্যায়াম শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে স্নায়ুকে শান্ত করে এবং উদ্বেগ কমায়। প্রতিদিন কয়েকবার এই পদ্ধতি অনুশীলন করলে দ্রুত প্রশান্তি পাওয়া যায়। 
  • প্রগ্রেসিভ মাসল রিল্যাক্সশন (Progressive Muscle Relxation) পদ্ধতিতে শরীরের প্রতিটি পেশী একটি নির্দিষ্ট সময় বিরতি দিয়ে আলাদা করে টান দেওয়া এবং শিথিল করা হয়। এতে পেশীর উপর সারাদিনে জমে থাকা চাপ কমে যায় এবং শারীরিক উত্তেজনা হ্রাস পায়। এর ফলে শরীর ও মন দুটোতেই গভীর শান্তির অনুভূতি অনুভব করা যায়।  
  • নির্দেশিত ধ্যানে সাধারণত অডিও বা ভিডিওর মাধ্যমে ধ্যানের নির্দেশনা অনুসরন করে একজন ব্যাক্তি ধ্যানে মগ্ন থাকতে পারেন। এটি নতুনভাবে যারা ধ্যান করছেন তাদের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নিয়মিত এই সেশনগুলো অনুশীলন করলে মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। 

হালকা গরম পানিতে গোসল করা

রাতের বেলায় ঘুমাতে যাবার আগে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করা শরীরকে শিথিল করতে সহায়তা করে এবং ঘুমের আবেশ নিয়ে আসে। গরম পানির তাপমাত্রা পেশীগুলোকে আরাম দেয় এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা সাময়িকভাবে বাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে শরীর যখন ঠান্ডা হতে শুরু করে, তখন আমাদের মস্তিস্ক শরীর ঘুমের জন্য প্রস্তুত হয়েছে বলে ধরে নেয়।

এই ধরনের গোসল শরীরের স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে উদ্বেগ বা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে থাকে। দিনের শেষে একটানা শারীরিক ও মানসিক চাপের পরে এটি একধরনের ফিজিক্যাল থেরাপি হিসেবে কাজ করে থাকে। শরীর যত বেশী শিথিল থাকে, ঘুম তত সহজে আসে। 

গোসল করার সময় গোসলের পরিবেশকেও আরামদায়ক করা জরুরী। হালকা আলো, শান্ত সঙ্গীত বা মোমবাতির আলোয় গোসল করা আমাদের মানসিক প্রশান্তি বাড়াতে পারে। এই ছোট ছোট উপাদানগুলো মিলেই গোসল করার একটি শান্তিপূর্ণ অভিজ্ঞতা তৈরি করে। 

গোসল করার সময় এসেনশিয়াল অয়েল ব্যবহার করলে এই অভিজ্ঞতা আরও গাঢ় হয়। ল্যাভেন্ডার, ক্যামোমাইল বা ইউক্যালিপটাসের নির্যাস গোসল করার আগে গরম পানিতে দুই এক ফোঁটা ঢেলে দিলে তা মানসিক চাপ কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এগুলো ঘ্রানের মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রশান্তি আনে এবং স্নায়ুকে শিথিল করে। 

নিয়মিতভাবে এমন গোসলের অভ্যাস গড়ে তোলা ঘুমের গুনগত মানকে উন্নত করতে পারে। এটি শরীর ও মনে একটি নিয়মিত ঘুমের রুটিন তৈরিতে সাহায্য করে। তাই ঘুমের আগে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করা রাতে ঘুমের প্রস্তুতি নেওয়ার একটি সহজ কিন্তু কার্যকর একটি পদ্ধতি হতে পারে। 


মৃদু সংগীত অথবা প্রাকৃতিক শব্দ শোনা

মৃদু যন্ত্রসংগীত, ধ্রুপদী সুর বা প্রকৃতির শব্দ ঘুমের জন্য এক প্রশান্তিময় পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করে। এই ধরনের সঙ্গীত মনকে শান্ত করে ও চিন্তার গতি ধীর করে দেয়। বিশেষ করে রাতের বেলায় এসব শব্দ বা সঙ্গীত শোনা ঘুমিয়ে পড়ার জন্য মস্তিস্ককে এক ধরনের ইতিবাচক সংকেত দিয়ে থাকে। 

ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদি যন্ত্রসঙ্গীতে কথা না থাকায় তা মনযোগ বিচ্ছিন্ন না করেই শরীর ও মনে শিথিলতা আনতে পারে। পিয়ানো, বেহালা বা সেতারার ধ্বনি ঘুমের আগে শুনতে বেশ আরামদায়ক লাগে। এই ধীরে চলা সুরগুলো শরীরের ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে মনে প্রশান্তির অনুভূতি নিয়ে আনে। 

প্রাকৃতিক শব্দ যেমন বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ, সাগরের ঢেউ বা বনের পাখির ডাক আমাদের মনে এক ধরনের নিরাপত্তা ও আরামদায়ক অনুভূতি সৃষ্টি করে। এই শব্দগুলো আমদের মস্তিষ্কে "সেইফ স্পেস" বা নিরাপদ পরিবেশ এর সংকেত পাঠায়। এর ফলে আমাদের মনে উদ্বেগ কমে আসে এবং আমরা সহজে ঘুমিয়ে পড়তে পারি। 

এই ধরনের সঙ্গীত বা শব্দ প্রতিদিন ঘুমের আগে শুনলে তা আমাদের দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে ওঠে। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে নিয়মিত এসব শব্দ শুনলে আমাদের মস্তিস্ক সেই শব্দগুলোর সাথে ঘুমের সময়কে যুক্ত করে ফেলে। ফলে ঘুম আসা সহজ হয় এবং ঘুমের গুনগত মানও উন্নত হয়।  


প্রতিকূল কার্যকলাপ এড়িয়ে চলা

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু কিছু অভ্যাস ও কার্যকলাপ আমাদের রাতে ঘুম না হওয়ার সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। নির্ঘুম রাতগুলোতে এসব এড়িয়ে চলা উচিৎ। এগুলো হলোঃ
  • সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার, গেম খেলা  বা ইউটিউবে উত্তেজনাপূর্ণ কন্টেন্ট দেখা ঘুমের ছন্দ বিঘ্নিত করতে পারে। এসব ডিভাইস থেকে নির্গত নীল আলো মস্তিস্ককে সক্রিয় রাখে এবং ঘুমের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। ফলে ঘুম আসতে দেরি হয় এবং এর ফলে মানসিক চাপও বাড়তে পারে। 
  • ক্যাফেইন ও চিনি শরীরকে সতেজ ও সজাগ রাখে, যা দিনের বেলায় আমাদের উপকারে লাগলেও, রাতে ঘুমিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে তা আমাদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই রাতে ঘুমিয়ে পড়ার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে চা, কফি, চকোলেট এবং কোমল পানি এড়িয়ে চলা উচিৎ। এই উপাদানগুলো ঘুমের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করে। 
  • রাতের বেলায় ঘুমানোর আগে অফিসের ইমেইল চেক করা, জটিল সমস্যার সমাধান করা বা মানসিক চাপ বাড়ায় এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা মানসিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে। এ ধরনের কাজ ঘুমের আগে মস্তিস্ককে অতিরিক্তভাবে সক্রিয় করে তোলে। ফলে ঘুম আসতে সময় লাগে এবং রাতে ভালো ঘুম হয় না। 

শেষ কথা

বিভিন্ন কারনে রাতে ঘুম না আসলে সেই সময়গুলো হতাশাজনক হতেই  হবে এমন কোন কারন নেই। এই আর্টিকেলে বর্নিত বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখলে এই সময়গুলো আপনার জন্য দারুনভাবে অর্থবহ হতে পারে। 

সবশেষে বলা যায়, মনোযোগ সহকারে এই মুহূর্তগুলো কাটাতে পারলে আত্মউন্নয়ন, প্রশান্তি এবং মানসিক শান্তি লাভ করা যায়। তবে ঘন ঘন অনিদ্রা দেখা দিলে দৈনন্দিন অভ্যাসগুলো পর্যালোচনা করা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪